Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পরিবর্তনপন্থী বিশিষ্ট মহলে মোহভঙ্গেরই আঁচ

এক সময়ে তাঁরা ‘পরিবর্তনের’ বীজ রোপণে সামিল হয়েছিলেন। ‘পরিবর্তনের’ ভোটের প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে তাঁদেরই ডাকে সাড়া দিয়ে তদানীন্তন শাসকের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভে দলমত নির্বিশেষে পথে নেমেছিল নাগরিক সমাজ।

শৃঙ্খলার অভাব দেখছেন যোগেন চৌধুরী, যা হয়েছে তা চাননি বিভাস চক্রবর্তী

শৃঙ্খলার অভাব দেখছেন যোগেন চৌধুরী, যা হয়েছে তা চাননি বিভাস চক্রবর্তী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

এক সময়ে তাঁরা ‘পরিবর্তনের’ বীজ রোপণে সামিল হয়েছিলেন। ‘পরিবর্তনের’ ভোটের প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে তাঁদেরই ডাকে সাড়া দিয়ে তদানীন্তন শাসকের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভে দলমত নির্বিশেষে পথে নেমেছিল নাগরিক সমাজ।

বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মমতা জমানার সূচনার প্রথম সঙ্কেতটা কার্যত মিলেছিল এ রাজ্যের সেই বিশিষ্টজনেদের হাত ধরেই। আর গত শনিবার বিধাননগর-আসানসোল-বালির পুরভোটপর্বের শেষে শাসকের বিরুদ্ধে সেই চেনা ক্ষোভের আঁচটাই ফের যেন মালুম হচ্ছে!

আগামী বিধানসভা ভোটের কম-বেশি ছ’-সাত মাস আগে এ বার সরকার তথা শাসকদলের বিরুদ্ধে সই করে বিবৃতি দিয়েছেন ২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের অনেকেই বাম জমানায় ‘পরিবর্তনের’
পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। এ বারও তাঁরা রাজ্যে ‘গণতন্ত্র আক্রান্ত’, ‘প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট’, ‘সাধারণ মানুষ বিপন্ন’ ইত্যাদি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়দের মতো কেউ কেউ অবশ্য যে কোনও জমানাতেই ধারাবাহিক ভাবে সরকার-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ইদানীং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের চেনা মুখেরাও অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘হতাশ’দের এই তালিকায় নতুন মুখ, খোদ শাসকদলের সাংসদ তথা চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীও। সোমবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসকদলের ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে যাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘যা দেখছি, আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।’’

তিনি যে কোনও রাজনৈতিক দলের দিকে আঙুল তুলছেন না, যোগেনবাবু তা স্পষ্ট করে বললেও ওঁর বক্তব্যে তৃণমূল অস্বস্তিতে পড়ে। মঙ্গলবার যোগেন তাতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ দিন চিত্রশিল্পীর দাবি, বামফ্রন্টের তুলনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঢের বেশি কাজ করেছে। ‘‘আমি সার্বিক ভাবে বাঙালির অবক্ষয় নিয়ে বলেছিলাম।’’— সোমবারের মন্তব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে এ দিন জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি এ-ও বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্র আক্রান্ত কি না জানি না। তবে এক ধরনের শৃঙ্খলার অভাব চোখে পড়ছে।’’

রাজ্যের বিশিষ্টজনেদের বড় অংশ কিন্তু সমস্যাটা স্রেফ শৃঙ্খলার খামতি হিসেবে দেখতে রাজি নন। বরং শাসকের গভীরতর এক নৈতিক সঙ্কট তাঁদের পীড়া দিচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, যে পরিবর্তন তাঁরা চেয়েছিলেন, তা কি এসেছে?

নাট্যকার কৌশিক সেন রাখ-ঢাক না-করে জানিয়েছেন, পরিবর্তনের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকের মতো তিনিও বীতশ্রদ্ধ। তবে এর মধ্যেও তিনি আশার আলো দেখছেন। ‘‘এটুকু বলব, নানা ভাবে ভয় দেখানো সত্ত্বেও মানুষ মুখ খুলছে। এবং আমি নিশ্চিত, আগামী দিনে আরও তীব্র ভাবে খুলবে। এটাও একটা শুরু বলা যায়।’’— পর্যবেক্ষণ কৌশিকের। কবি শ্রীজাতর মধ্যে কাজ করছে অন্য আশঙ্কা। ‘‘যে তিমিরে আমরা ছিলাম, ক্রমশ যেন সেই তিমিরেই ফের ঢুকে পড়ছি!’’— খেদ করেছেন তিনি।

বাম জমানায় কনভেনশন, গণবিবৃতি, মিছিল ইত্যাদির পথে হেঁটেছিল নাগরিক সমাজ। শ্রীজাতর মতে, সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন না-করলেও তাঁর ক্ষমতায় আসার পিছনে সেই নাগরিক আন্দোলনের বড় ভূমিকা ছিল। তিনি মনে করছেন, নাগরিক সমাজের ফের আরও ব্যাপক ভাবে পথে নামার পরিস্থিতি ক্রমশ তৈরি হচ্ছে। ‘‘জয় নিশ্চিত, এমন একটা পুরভোটে যদি শাসক এতটা হিংস্র, মরিয়া হয়ে ওঠে, তা হলে বিধানসভা ভোটে রাজ্যের মসনদে বসার উপলক্ষ সামনে এলে কী ঘটতে পারে ভেবে আমার হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে!’’— বলছেন শ্রীজাত।

তবে বর্ষীয়ান নাট্যকর্মী বিভাস চক্রবর্তী ‘বীতশ্রদ্ধ হওয়া’র মতো শব্দে ঢুকতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শুধু এটুকু বলব, যা হয়েছে তা চাইনি।’’ বাম আমলে পরিবর্তনের পক্ষে সওয়ালকারীদের অগ্রগণ্য বিভাস এ বার কোনও বিবৃতিতে সই করেননি। রাজ্যের সাম্প্রতিক পুরভোটের প্রেক্ষিতে তিনি বলছেন, ‘‘টিভি-তে যা দেখেছি, তা গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। নিন্দনীয়। আগে কী হয়েছে, সে প্রসঙ্গে যাব না। কারণ, ওই ধরনের হিংসার বিরুদ্ধেই তো আমরা তখনও প্রতিবাদ করেছিলাম!’’

পুরভোট পর্বের পটভূমিতে যাঁরা বিবৃতিতে সই করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন বিনোদন জগতের চেনা মুখ— অভিনেতা-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনিও তাঁর অবস্থানের মধ্যে বীতশ্রদ্ধ বা মোহভঙ্গ হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি ধরছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মোহ থাকলে তো মোহভঙ্গ হবে! এ দেশে রাজনীতিতে যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ! পরে অন্য কেউ এলেই বা কী ম্যাজিক ঘটবে!’ নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের সময়ে সদ্য যুবক পরম ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর পরে লালবাজার-অভিযানে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি এখন বলছেন, ‘‘আমি সব সময়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে মিছিল-টিছিল এড়িয়ে চলি। যথার্থ মুক্তমনাদের স্বাধীন মননেই যা বলার বলে যেতে হবে।’’

শাসকের ভূমিকা সম্পর্কে এ হেন ক্ষোভের আবহেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু পাশে পেয়ে যাচ্ছেন কয়েক জন বিশিষ্টকে। এ ক্ষেত্রে অতীতের পরিবর্তনের নেপথ্যের গুরুত্বপূর্ণ মুখ তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ-সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ও সাবেক বাম-অনুগামী, অধুনা মমতা-ঘনিষ্ঠ কবি সুবোধ সরকার যেমন কার্যত এক নৌকোয়। তিনি রাজনীতির মানুষ নন বলে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতেই চাননি শুভাপ্রসন্ন। কিন্তু তিনিই তো এর আগে পরিবর্তনের অন্যতম হোতা ছিলেন?

এ দিন শুভার জবাব, ‘‘ফের পরিবর্তন চাওয়ার অবস্থা হলে না হয় ভাবব, কী করা যায়।’’ সুবোধ আবার তৎপর হয়েছেন ভোট-সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে নেত্রীকে বিযুক্ত করতে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সাংবাদিক নিগ্রহ দেখে আমি যন্ত্রণা পেয়েছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু মার খেয়ে গণতন্ত্র নিয়ে এসেছেন। সেখানে কালি ছিটোচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের শাস্তি হোক।’’

আর পরিবর্তনপন্থী থেকে একদা মমতার প্রতি বিক্ষুব্ধ, অধুনা তাঁর ‘একনিষ্ঠ সমর্থক’ কবীর সুমন মনে করছেন, পুরভোটে যা ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব কিছু নয়। বস্তুত ফেসবুকে তিনি প্রশ্নও তুলেছেন— এ ব্যাপারে এত হইচইয়ের কী আছে? ‘‘কয়েকটি বিষয়ে মমতা সরকারের সমালোচনা করলেও আমি মনে করি, ওঁরা অনেক কাজ করেছেন। ওঁরাই ক্ষমতায় থাকুন!’’— বলেন সুমন।

যদিও ভোটে গা-জোয়ারির ক্ষেত্রে রাজ্যে কোনও পরিবর্তন হয়নি বলে মানছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE