Advertisement
০৩ মে ২০২৪
জাল গোটাচ্ছে সিবিআই

প্রাক্তন ডিজি ও ক্লাবকর্তার বাড়িতে তল্লাশি

চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, সারদা কেলেঙ্কারিতে জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনছে সিবিআই। বৃহস্পতিবার দিনভর যে তল্লাশি চালাল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, তাতে এই ছবিটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সিবিআই গোয়েন্দারা তল্লাশির তালিকায় এক দিকে যেমন সুদীপ্ত সেনের সংস্থার অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে ডিরেক্টরকে রেখেছিলেন, অন্য দিকে আবার হানা দিয়েছেন তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন আইপিএস অফিসার থেকে ক্লাবকর্তার বাড়িতে।

বাড়িতে সিবিআই তল্লাশির পরে দেবব্রত সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

বাড়িতে সিবিআই তল্লাশির পরে দেবব্রত সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০৪:১০
Share: Save:

চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, সারদা কেলেঙ্কারিতে জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনছে সিবিআই।

বৃহস্পতিবার দিনভর যে তল্লাশি চালাল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, তাতে এই ছবিটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সিবিআই গোয়েন্দারা তল্লাশির তালিকায় এক দিকে যেমন সুদীপ্ত সেনের সংস্থার অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে ডিরেক্টরকে রেখেছিলেন, অন্য দিকে আবার হানা দিয়েছেন তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন আইপিএস অফিসার থেকে ক্লাবকর্তার বাড়িতে। যা দেখেশুনে অনেকেই মনে করছেন, কোনও বড় মাপের রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের ঘনিষ্ঠদের জেরা করাটা সেই প্রস্তুতিপর্বেরই অঙ্গ।

আজ কলকাতা, দিল্লি, গুয়াহাটি ও ওড়িশার মোট ৩০টি জায়গায় সারা দিন ধরে তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই। কলকাতার মোট ২২টি জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে তারা। যার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য, কলকাতায় তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদারের বাড়ি। সিবিআই সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের ডিজি-র পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর গত কয়েক বছরে তৃণমূলের এক অন্যতম শীর্ষনেতার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন রজতবাবু। সারদা সংস্থা থেকে নিয়মিত বেতনও পেতেন তিনি। অভিযোগ, আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের যোগসূত্র। সুদীপ্ত সিবিআই-কে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা তৃণমূলের নেতাদের চাপে পড়েই লিখেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। ওই চিঠি লেখার ক্ষেত্রেও রজতবাবুর ভূমিকা ছিল বলে খবর।

রজত মজুমদারের বাড়িতে সিবিআই তল্লাশির পরে অনেকেই মনে করছেন, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি প্রথমেই বড় মাপের কোনও রাজনৈতিক নেতাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছে না। সিবিআইয়ের একটি সূত্রের বক্তব্য, প্রথমেই নেতাদের জেরা করা হলে সংবাদমাধ্যমে হইচই হবে। অভিযোগ উঠবে, সিবিআই-কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। মাঝখান থেকে তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে আগে ওই সব নেতাদের চার পাশের বৃত্ত ছোট করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। সেই জন্যই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ থেকে শুরু করে সারদার সাধারণ কর্মীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই নেতাদের কাছে পৌঁছনোর সূত্র খোঁজা হচ্ছে।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন

আজ সিবিআইয়ের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “সারদা কেলেঙ্কারিতে যে কিছু রাজনৈতিক নেতার মদত ছিল, তা সকলেই জানেন। কিন্তু প্রথমেই সিংহের গুহায় হাত দিলে মুশকিল হতে পারে।” তিনি জানান, সুদীপ্ত সেনের প্রতারণার কারবারে যাঁরা পিছন থেকে মদত দিয়েছেন এবং তার ফায়দা কুড়িয়েছেন, তাঁদের ধরতে গেলে আগে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রয়োজন। যাতে এক বার ধরা হলে আর তাঁরা জাল কেটে বেরিয়ে যেতে না পারেন। ওই কর্তা বলেন, “সেই কারণেই আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। প্রথমে শক্ত করে কান ধরার চেষ্টা হচ্ছে। কান টানলেই মাথা আসবে।”

রজত মজুমদারের বাড়িতে তল্লাশি সেই প্রক্রিয়ারই প্রথম ধাপ বলে জানাচ্ছেন সিবিআই কর্তারা। সকাল থেকেই নর্থ ব্লকের দোতলায় নিজের দফতরে বসে গোটা অভিযানের উপর নজর রাখছিলেন সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিৎ সিন্হা। কোথায় কী ধরনের নথিপত্র মিলছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় রিপোর্ট

আসছিল তাঁর কাছে। দিনের শেষে তিনি জানান, তল্লাশি পর্ব এখানেই থামছে না। আরও চলবে। সিবিআইয়ের মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদ বলেন, “আজ তল্লাশি চলাকালীন সারদা সংস্থায় আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বহু নথিপত্র উদ্ধার হয়েছে। আগামী দিনে এই তদন্ত কোন দিকে এগোবে, বাজেয়াপ্ত নথিপত্র থেকে তার দিশা মিলতে পারে।” সিবিআই সূত্রের খবর, এ দিন কলকাতার গোলপার্কের একটি ব্যাঙ্কেও তল্লাশি চালান তদন্তকারীরা। সিবিআই কর্তাদের বক্তব্য, আজ যাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে, তাঁদের অনেকের কাছ থেকেই বহু নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ওই সব নথিপত্র পরীক্ষার পর প্রয়োজন হলে এঁদের গ্রেফতারও করা হতে পারে।

রজতের বাড়ি ছাড়াও আজ দিল্লি ও গুয়াহাটিতে নরসিংহ রাওয়ের জমানায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহ ও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনার বাড়ি ও দফতর, কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার, ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধী ও কলকাতার ব্যবসায়ী শান্তনু ঘোষের বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছে। সুদীপ্ত সেন সিবিআইকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন, সেবি-র চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে দাবি করে তাদের থেকে ছাড়পত্র জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন দেবব্রতবাবু। সারদার বেআইনি কাজকর্মে চোখ বুজে থাকার পিছনে সেবি-র কোনও কর্তার বিশেষ ভূমিকা ছিল কি না, আগামী দিনে তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। সিবিআই সূত্রের খবর, জেনাইটিস গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান শান্তনুকে পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। শান্তনুর মোটরবাইক নির্মাতা সংস্থা গ্লোবাল অটোমোবাইলসে বিনিয়োগের জন্যও ৫৪ কোটি টাকা খরচ করেন সারদা-প্রধান। কিন্তু সেখানে কোনও মোটরবাইক তৈরির প্রমাণই মেলেনি! তা হলে কেন এত অর্থ বিনিয়োগ করা হল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শান্তনুকে অবশ্য সারদা-কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে ইডি।

এঁরা ছাড়া আজ বাকি যাঁদের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে, তাঁরা সকলেই সারদার বিভিন্ন সংস্থার পদস্থ কর্মী। কেউ ডিরেক্টর, কেউ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কেউ বা ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার। সুদীপ্তদের এক আইনজীবী ও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছে। সিবিআই সূত্র বলছে, সারদার ডিরেক্টর বা ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজাররাও গরিব মানুষের প্রতারণার টাকা নিজেদের পকেটে পুরেছেন। কিন্তু সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা মনে করছেন, গুরুত্বপূর্ণ হল, সারদার টাকা কী ভাবে হাতবদল হতো, কোনও ভাবে তা রাজনৈতিক নেতাদের সিন্দুকে পৌঁছত কি না, পৌঁছলে কী ভাবে, তা এই সব ডিরেক্টর বা সাধারণ কর্মীরা বলে দিতে পারেন।

প্রাথমিক তদন্তের পরে সিবিআই অফিসারদের ধারণা, সারদার সংস্থাগুলির পরিচালন বোর্ডে মূলত সুদীপ্ত সেন, তাঁর ছেলে শুভজিৎ, স্ত্রী পিয়ালি, অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায় ছাড়া মুষ্টিমেয় কয়েক জন ব্যক্তিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকতেন। যাঁদের মধ্যে পৌলমী মুখোপাধ্যায়, মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় ও অশোক বিশ্বাসের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। সারদা রিয়ালটি-র সিইও সুদীপ ঘোষদস্তিদারের বাড়িতেও তল্লাশি হয়।

আজ দিল্লিতে প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের গোলমার্কেটের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। মাতঙ্গের প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনার দিল্লি ও গুয়াহাটির বাড়ি ও দফতরেও তল্লাশি চালায় সিবিআই। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের বক্তব্য, মাতঙ্গের মালিকানাধীন এক সংবাদমাধ্যমের অর্ধেক অংশীদারিত্ব কেনার জন্য তাঁকে ২৮ কোটি টাকা দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। একই সঙ্গে অভিযোগ, মনোরঞ্জনা ও তাঁর বাবা এন কে গুপ্তকে দেশের বিভিন্ন শহরের হোটেলে থাকা ও যাতায়াতের খরচ বাবদ ২৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল সারদার তরফে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা কেন দেওয়া হয়েছিল, তা-ও তদন্তে খতিয়ে দেখছে সিবিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam ex dg
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE