Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
নজরদারের নির্যাতন পরীক্ষায়

পাহারা হটিয়ে প্রতিবন্ধীকে অভয় পর্ষদের

সহৃদয় সহানুভূতির দরকার ছিল তার। তা তো হলই না। উল্টে শারীরিক ভাবে অক্ষম এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে মানসিক ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠল নজরদারের বিরুদ্ধে। অভিভাবকদের অভিযোগ, ওই নজরদারের ভয়ে ছেলেটি এমনই সিঁটিয়ে গিয়েছে যে, আর পরীক্ষা দিতে যেতে চাইছে না।

শুক্রবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসছে সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

শুক্রবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসছে সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

দেবাশিস দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

সহৃদয় সহানুভূতির দরকার ছিল তার। তা তো হলই না। উল্টে শারীরিক ভাবে অক্ষম এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে মানসিক ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠল নজরদারের বিরুদ্ধে। অভিভাবকদের অভিযোগ, ওই নজরদারের ভয়ে ছেলেটি এমনই সিঁটিয়ে গিয়েছে যে, আর পরীক্ষা দিতে যেতে চাইছে না। ছেলে যাতে ভয় কাটিয়ে বাকি পরীক্ষা দিতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন নিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও জেলা শিক্ষা সংসদের দ্বারস্থ হয়েছেন বাবা-মা।

চটজলদি ব্যবস্থা নিয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। তারা জানিয়ে দিয়েছে, ছাত্রটি যে-ঘরে পরীক্ষা দেবে, তার ভিতরে যেন কোনও নজরদার না-থাকেন। ঘরে ‘রাইটার’ (অনুলেখক) আর ছাত্রটি ছাড়া কেউ থাকবে না। স্কুল-কর্তৃপক্ষের দাবি, সোমবার প্রথম দিন একটু সমস্যা হয়েছিল ঠিকই। পরে তা মিটেও গিয়েছে।

ছাত্রটি কেমন নির্যাতনের শিকার?

হাওড়া মধ্য শিক্ষালয়ের ছাত্র সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরীক্ষার সিট পড়েছে হাওড়া টাউন স্কুলে, নিজের স্কুলের অন্য ছাত্রদের সঙ্গেই। ‘স্প্যাস্টিক’ বা শারীরিক ভাবে অক্ষম হওয়ায় সুমন্ত্রের জন্য পরীক্ষা কেন্দ্রে দু’জন ‘রাইটার’ রাখার অনুমতি দেয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। ওই অনুলেখকদের কাজ হবে সুমন্ত্রের কাছ থেকে উত্তর শুনে লিখে দেওয়া। ঠিক হয়, নবম শ্রেণির দু’জন ছাত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনুলেখকের কাজ করবে। পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী সুমন্ত্রকে বসানো হবে আলাদা ঘরে। ঘরে ‘রাইটার’ ছাত্রটি ছাড়াও উপস্থিত থাকবেন এক জন ‘ইনভিজিলেটর’ বা নজরদার শিক্ষক।

ছাত্রটির মা মালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, সোমবার, প্রথম পরীক্ষার দিনেই নজরদারের ব্যবহারে সুমন্ত্র ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ‘‘বাকি ক’দিন কী ভাবে যে ওকে পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছি, তা আমিই জানি। বুঝতে পারছিলাম, পরীক্ষার হলে এমন কিছু ঘটেছে, যার জন্য আমার ছেলের ভবিষ্যৎটাই পুরোপুরি অন্ধকারে চলে যেতে বসেছিল,’’ বললেন মালাদেবী।

কী ঘটল পরীক্ষার হলে?

নবম শ্রেণির অনুলেখক ছাত্রের অভিযোগ, ‘‘প্রথম দিন থেকে স্যার (নজরদার) চেয়ারে বসে হুমড়ি খেয়ে এমন ভাবে সোজা তাকিয়ে ছিলেন, যে-কোনও পরীক্ষার্থীই ঘাবড়ে যাবে। সুমন্ত্রও ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্যার ভয়ও দেখাচ্ছিলেন ওকে। বলছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি উত্তর বল। না-হলে খাতা কেড়ে নেব।’ মানসিক ভাবে দুর্বল সুমন্ত্র কাঁপতে থাকে, ঘামতে থাকে।’’

এখানেই শেষ নয়। রাইটার ছাত্রটির আরও অভিযোগ, ‘‘একটি ১৬ নম্বরের প্রশ্নের উত্তর আমি লিখে দিয়েছি বলে অভিযোগ তুলে গোটা উত্তরটাই লাল পেন দিয়ে কেটে দেন ওই স্যার।’’ বাকি প্রশ্নের উত্তর লিখতে গেলে আগে ওই শিক্ষকের কাছে সুমন্ত্রকে গোটা উত্তর বলতে বাধ্য করানো হয়েছে বলে অভিযোগ। ‘‘স্যারের কাছে উত্তর বলার পরে লেখার অনুমতি পেয়েছি। ফলে সময় নষ্ট হয়েছে,’’ বলল অনুলেখক। নবম শ্রেণির ওই ছাত্রের অভিযোগ, সুমন্ত্রকে জল পর্যন্ত খেতে দেননি নজরদার। এমন ধমক দেন যে ভয়ে প্যান্টেই প্রস্রাব করে ফেলে সুমন্ত্র।

পরের দু’দিন একই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ মালাদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘ছেলে এত ভয় পেয়েছে যে, ঘনঘন বমি করছে। খেতে পারছে না। রাতে ঘুমোতে পারছে না। ঘুমের ওষুধ দিতে হচ্ছে।’’ মায়ের আক্ষেপ, চিকিৎসকদের পরামর্শে সুমন্ত্রকে আর-পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করাতে বাংলা স্কুলে দেওয়া হয়েছিল। পড়াশোনা ভালই করছিল সে। ‘‘কিন্তু পরীক্ষা দিতে এসে ছেলে যে-মানসিক নির্যাতনের মুখে পড়ল, তার ফল যে কী হবে, বুঝতে পারছি না,’’ দুর্ভাবনায় পড়ে গিয়েছেন মা।

পরীক্ষা কেন্দ্রে তাঁর ছেলের উপরে নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য মালাদেবী শুক্রবার পর্ষদের সচিব ও জেলা স্কুল পরিদর্শককে চিঠি দেন। জেলা স্কুল পরিদর্শক তাপস বিশ্বাস ওই স্কুলে যান। পরে তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সব জানানো হয়েছে। যতটা অভিযোগ করা হচ্ছে, ততটা ঠিক কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কল্যাণকুমার সিট বলেন, ‘‘যে-সব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সবটাই ঠিক নয়।’’ তবে অভিযুক্তের পরিচয় জানাতে চাননি স্কুল-কর্তৃপক্ষ।

পর্ষদ অবশ্য লিখিত অভিযোগের অপেক্ষায় থাকেনি। পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি ভাবে অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি শুনেই ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলেছি, ওই ঘরে পরিদর্শক রাখার প্রয়োজন নেই। শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে ঘরের বাইরে পায়চারি করতে পারেন। ঘরে রাইটার আর ছাত্রটি ছাড়া কেউ থাকবে না।’’ সুমন্ত্র আজ, শনিবার মানসিক চাপ ছাড়াই ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে পারবে বলে মালাদেবীর আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE