Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ফি বছর কি ডি-লিট না দিলেই নয়, উঠছে প্রশ্ন

কড়া পুলিশি পাহারা থেকে শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান নাটকের পর নাটক চলল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে। আর সেই অনুষ্ঠানে দেশের প্রাক্তন ফুটবল অধিনায়ক তথা লোকসভা ভোটের অন্যতম তৃণমূল প্রার্থী সাম্মানিক ডি-লিট পাওয়ার পর প্রশ্ন উঠল, ফি-বছর সমাবর্তনে কাউকে ধরেবেঁধে এনে একটা সাম্মানিক ডিগ্রি না দিলেই কি নয়? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাম্মানিক ডক্টরেট প্রাপকের নাম বাছাইয়ের দিকটিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠল। এবং প্রশ্ন উঠল, ‘সমাবর্তন’ বলে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানটা রাখার আদৌ দরকার আছে কি না।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ। ছবি:শশাঙ্ক মণ্ডল

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ। ছবি:শশাঙ্ক মণ্ডল

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

কড়া পুলিশি পাহারা থেকে শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান নাটকের পর নাটক চলল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে। আর সেই অনুষ্ঠানে দেশের প্রাক্তন ফুটবল অধিনায়ক তথা লোকসভা ভোটের অন্যতম তৃণমূল প্রার্থী সাম্মানিক ডি-লিট পাওয়ার পর প্রশ্ন উঠল, ফি-বছর সমাবর্তনে কাউকে ধরেবেঁধে এনে একটা সাম্মানিক ডিগ্রি না দিলেই কি নয়? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাম্মানিক ডক্টরেট প্রাপকের নাম বাছাইয়ের দিকটিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠল। এবং প্রশ্ন উঠল, ‘সমাবর্তন’ বলে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানটা রাখার আদৌ দরকার আছে কি না।

সমাবর্তন করা না-করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দু’রকম মতই দিয়েছেন শিক্ষাবিদেরা। তবে একটি বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। তা হল, প্রত্যেক বছর কাউকে না কাউকে সাম্মানিক ডি-লিট বা ডি-এসসি দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।

চলতি বছরে কাকে বা কাদের সাম্মানিক ডক্টরেট দেওয়া হবে, তা নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। প্রথমে তিনটি নাম নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলেন যাদবপুর কর্তৃপক্ষ অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন, শিল্পপতি মুকেশ অম্বানি অথবা প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু এঁরা কেউই রাজি হননি। অগত্যা ভাইচুং ভুটিয়াকেই বুধবার সাম্মানিক ডি-লিট দিল যাদবপুর।

কিন্তু ক্রীড়াবিদের বাইরে ভাইচুংয়ের রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। লোকসভা ভোটে দার্জিলিঙে বিমল গুরুঙ্গের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন তৃণমূল নেত্রীর তাস। স্বভাবতই রাজ্যের শাসক দলকে তুষ্ট করার লক্ষ্যেই যাদবপুর কর্তৃপক্ষ এ বছর ভাইচুংকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কোনও কোনও শিক্ষক। বিশেষত উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী যেখানে রাজ্য সরকারের ‘কাছের লোক’ হিসেবেই পরিচিত। ছাত্র-বিক্ষোভে গদি টলমল করলেও সরকার আগাগোড়া তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চাননি। তবে শিক্ষক সংগঠন ‘জুটা’ অভিযোগ তুলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন না মেনে সাম্মানিক ডিগ্রি প্রাপকের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে।

কাজেই প্রশ্ন উঠেছে, এই আয়োজনের আদৌ প্রয়োজন কতটা?

বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আসা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মন্তব্য, “প্রত্যেক বছর সমাবর্তন করতেই হবে, তেমন কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিদেশে এবং ভারতের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতি বছর সমাবর্তনের রীতি রয়েছে। তা কেবল পাশ করে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র দেওয়ার জন্য। নিয়ম করে কাউকে না কাউকে সাম্মানিক ডি-লিট, ডি-এসসি দিতেই হবে, এমন রেওয়াজ নেই।”

ওই অধ্যাপক জানান, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিচারে সর্বোচ্চ সম্মান ডি-লিট বা ডি-এসসি। তাই অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক বছরই কাউকে না কাউকে এই ধরনের সাম্মানিক ডিগ্রি দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বরং খুব ভেবেচিন্তে সম্মান প্রাপকদের নাম বাছাই করা হয়। কারণ, সম্মান জানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক ওঠাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অসম্মানের। কেমব্রিজে যেমন এই ধরনের সম্মান প্রাপকের নাম প্রস্তাব করতে পারেন কেবল সেখানকারই প্রাক্তনীরা। তার পরে আরও অনেক আলাপ-আলোচনা, মতামতের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয় নাম। ভারতীয়দের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই বিরল সম্মান প্রাপকদের অন্যতম।

তা হলে এ রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিয়ম করে প্রতি বছর ডি-লিট, ডি-এসসি দেয় কেন?

বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তি, একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যই এই প্রথা। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে রাজনৈতিক কারণের কথাও বলছেন কেউ কেউ। একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কথায়, “আজকাল আর ডি-লিট, ডি-এসসি প্রাপকদের নাম নিয়ে মাথা ঘামাই না। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই তো দেখি প্রাপকদের নাম স্থির করা হয়।”

আইআইএম-কলকাতার এক কর্তার কথায়, “গত কয়েক বছর আমাদের এখানে ডি-লিট বা ডি-এসসি দেওয়া হয়নি। এটা তো সাম্মানিক ব্যাপার। এটা নিয়ম করে হয় না!” শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মন্তব্য, “সমাবর্তন শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি অলঙ্করণ। তবে প্রত্যেক বছর সাম্মানিক ডি-লিট, ডি-এসসি দেওয়ায় আমার সমর্থন নেই।” জুটার সাধারণ সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়েই নিজের অপছন্দের কথা জানিয়ে বলেছেন, ছাত্রাবস্থাতেও তিনি ‘ওই ভাবে’ মঞ্চে উঠে শংসাপত্র নেননি। আবার যাদবপুরের এমেরিটাস অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, গুরুত্ব কমতে কমতে সমাবর্তন আজকের দিনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক বছর সাম্মানিক ডি-লিট বা ডি-এসসি দেওয়া অনর্থক বলে মনে করেন তিনিও।

তবে উল্টোটাও বলছেন কোনও কোনও শিক্ষাবিদ। যেমন, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ, আইআইএম কলকাতার অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহ, যাদবপুরের ইংরেজির অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার প্রমুখ। তাঁদের মতে, সমাবর্তনের প্রয়োজন আছে। ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকে। যা জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jadavpur university convocation d-lit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE