নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ডিএম-এসপিদের বদলি করেছিল রাজ্য। কিন্তু সেই বিজ্ঞপ্তিতেই একই সঙ্গে তারা জানিয়েছিল, এই বদলি ভোট-প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত। তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কী ভাবে বদলির মেয়াদকাল সম্পর্কে এমন কথা বলেছে রাজ্য এই প্রশ্ন তুলে এ বারে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি পাঠিয়ে কৈফিয়ত তলব করল কমিশন। দিল্লির নির্বাচন সদন থেকে রাজ্যের সদর দফতরে পাঠানো ওই চিঠিতে আরও জানানো হয়েছে, কমিশন বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেয়নি। আজ, রবিবার বেলা ১১টার মধ্যে এই কৈফিয়তের জবাব দিতে বলা হয়েছে মুখ্যসচিবকে।
কমিশনের সচিব আর কে শ্রীবাস্তবের লেখা ওই চিঠি (নম্বর: ৪৩৪/১/ডব্লিউবিএইচপি/২০১৪) নবান্নে পৌঁছেছে ২৫ এপ্রিল বিকেলে। তাতে রাজ্যের পাঁচ জেলার পুলিশ সুপার, এক জেলাশাসক ও দুই অতিরিক্ত জেলাশাসকের বদলি সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তির কথা তুলে কমিশন লিখেছে, ৭ এপ্রিল কমিশন যে নির্দেশ দেয়, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজ্য প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করে এবং তা অবিলম্বে কার্যকরও হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ভোট-প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্তই এই বদলি কার্যকর থাকবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কেন ‘ভোট-প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত’ কথাগুলি লেখা হল, তা কমিশন মোটেও ভাল ভাবে নেয়নি। এর পরেই ওই চিঠিতে কৈফিয়ত তলব করে কমিশন।
শনিবার এ নিয়ে মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের সংঘাতের শুরু ৫ এপ্রিলের পর থেকে। ভোটের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে ওই দিন এ রাজ্যে এসেছিল কমিশনের ফুল বেঞ্চ, যার নেতৃত্বে ছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত স্বয়ং। দু’দিন ধরে তাঁরা মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজ্য পুলিশের ডিজি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন। তখনই বিরোধীরা বেশ কয়েক জন পুলিশ সুপার ও জেলাশাসকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করেন। সরকারি সূত্রে খবর, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে নিজেদের সূত্রে খোঁজখবর শুরু করে কমিশন। ৬ তারিখ ফুল বেঞ্চ দিল্লিতে ফিরে যায়। তার পর দিনই বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি, উত্তর ২৪ পরগনার ডিএম এবং পশ্চিম মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুই অতিরিক্ত জেলাশাসককে সরানোর জন্য রাজ্যকে নির্দেশ দেয় কমিশন।
কমিশনের এই নির্দেশ নবান্নে পৌঁছতেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে কমিশন কেন একতরফা ভাবে অফিসারদের বদলির নির্দেশ দিল, এই প্রশ্ন তুলে বেঁকে বসেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিনই বর্ধমানে এক জনসভায় মমতা ঘোষণা করেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এক জন অফিসারকেও সরাবেন না। এ জন্য দরকারে জেলে যেতেও প্রস্তুত তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য শোনার পরেই প্রমাদ গুনতে শুরু করেন প্রশাসনের কর্তারা। কারণ, কমিশন নির্দেশ দিচ্ছে অথচ রাজ্য প্রশাসন তা মানছে না এ ঘটনা অভূতপূর্ব। এর ফলে সাংবিধানিক অচলাবস্থা তৈরি হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। মুখ্যমন্ত্রীকে তখন প্রশাসনের কর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন, বদলি নিয়ে সরকারের ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে নির্দেশ মানা ছাড়া গতি নেই। তা না হলে ভোট বাতিলও করে দিতে পারে কমিশন। নবান্নের খবর, পরিস্থিতি অনুকূল নয় বুঝে পরের দিন, অর্থাৎ, ৮ এপ্রিল রাতে দুর্গাপুরে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ তিনি মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু ভোট মিটলেই বদলি হওয়া আট জন অফিসারকে আগের পদে ফিরিয়ে আনবেন।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি যে নিছকই মুখের কথা নয়, তা বোঝাতে ৯ এপ্রিল সকালে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর এবং কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর পৃথক ভাবে আট জনের বদলি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে। লেখা হয়: ভোট প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত (আনটিল দ্য ইলেকশন প্রসেস ইজ কমপ্লিটেড) ওই বদলির নির্দেশ কার্যকর থাকবে। এই বিজ্ঞপ্তি সে দিন দুপুরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছেও পাঠিয়ে দেয় রাজ্য। এটি নিয়েই এ বারে মুখ্যসচিবের জবাব তলব করেছে কমিশন।
৯ই সকালে জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তি অবশ্য সন্তুষ্ট করতে পারেনি বদলি হওয়া অফিসারদের একাংশকে। তাঁরা সেই ক্ষোভ গোপনও রাখেননি। নবান্নের এক কর্তা জানান, প্রশাসনের শীর্ষ মহলকে তাঁরা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেন, বিজ্ঞপ্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কোনও প্রতিফলন নেই। অর্থাৎ, ভোট শেষ হওয়ার পরে অফিসারদের আগের পদে ফেরানোর যে অঙ্গীকার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার কোনও ইতিবাচক ইঙ্গিত নেই বদলির ওই নির্দেশে।
নবান্নের খবর, এই ক্ষোভের কথা জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রীও। তার পরে সে দিনই বিকেলে বৈঠকে বসেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, সকালে যে বদলির নির্দেশ বেরিয়েছে, সেই মেমো নম্বর উদ্ধৃত করে নতুন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। সেই মতো রাতে নতুন বিজ্ঞপ্তিটি জারি করে বদলি-অফিসারদের আগের পদে ফিরিয়ে আনার কথা জানিয়ে দেন মুখ্যসচিব। এ-ও বলা হয়, বদলি হওয়া অফিসারদের আবার আগের পদে ফিরে যেতে কিংবা দায়িত্ব বুঝে নিতে পরে আর কোনও নির্দেশ জারি হবে না। এই বিজ্ঞপ্তির প্রতিলিপি অবশ্য সরকারি ভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়নি বলে নবান্ন সূত্রের খবর।
শুধু এই নির্দেশই নয়, পরে ২২ এপ্রিল কমিশন যখন বিভিন্ন জেলার ২০ জন পুলিশ অফিসার ও তিন বিডিওকে বদলি করে, সে ক্ষেত্রেও একই নির্দেশিকা জারি করে রাজ্য। পক্ষপাতের অভিযোগে ওই ২৩ জনকে বদলির নির্দেশ দেয় কমিশন। সরকার তা মেনে নিয়ে ভোটের পর তাঁদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে অবশ্য কমিশন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি বলে নবান্ন সূত্রে খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy