Advertisement
১১ মে ২০২৪
আসরে মমতা নিজেই

বনধ রুখতে কেন্দ্র-রাজ্য জোট, বলছে বাম

বুধবারের সাধারণ ধর্মঘট ব্যর্থ করতে নিজেই আসরে নামলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে যুদ্ধ হবে’— ২ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর দিকে এই ভাষায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন বিরোধী বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।

ধর্মঘটের সমর্থনে বামেদের মিছিল। সোমবার ধর্মতলা চত্বরে।

ধর্মঘটের সমর্থনে বামেদের মিছিল। সোমবার ধর্মতলা চত্বরে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

বুধবারের সাধারণ ধর্মঘট ব্যর্থ করতে নিজেই আসরে নামলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে যুদ্ধ হবে’— ২ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর দিকে এই ভাষায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন বিরোধী বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। সেই যুদ্ধের কৌশল ঠিক করতে সোমবার নিজেই ব্যাটন হাতে তুলে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের খবর, রাজ্য জুড়ে বন্‌ধ বা ধর্মঘটের ডাক থাকলে সাধারণত জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠক করে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে সরকারি অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দেন মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি। নবান্ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ দিন সেই বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি তাঁর কঠোর নির্দেশ, যে কোনও মূল্যে জোর করে ধর্মঘট করার চেষ্টা রুখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ করতেও যেন প্রশাসন পিছপা না হয়। গুলি না-চালিয়ে ধর্মঘট মোকাবিলার প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— জানান প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা।

অন্যান্য বারের তুলনায় নবান্নের এই সাজ সাজ রব দেখে ধর্মঘটীরা মোদী-মমতার রাজনৈতিক আঁতাঁতের অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, ধর্মঘট যেখানে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে, তখন মমতার প্রশাসন কেন কোমর বেঁধে পথে নামছে। কার্যত বিরোধীদের অভিযোগকে আরও জোরালো করে তুলেছে এ দিন সরকারি কর্মীদের জন্য দুই সরকারের জারি করা বিজ্ঞপ্তির ভাষা। প্রশাসনের কর্তারা জানান, কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তির মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। ধর্মঘটের দিন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের অফিসে হাজির থাকতে বলে মোদী সরকারের অর্থ মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ধর্মঘটে যোগ দিলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অফিসে এসে ‘পেন-ডাউন’, ‘গো-স্লো’ বা ‘সিট-ডাউন’-এর মতো বিক্ষোভে যোগ দিলেও তা ধর্মঘট হিসেবেই ধরা হবে। ওই দিন কোনও কর্মীকে ‘ক্যাজুয়াল লিভ’-ও মঞ্জুর করা হবে না। বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিতির জন্য চাকরিতেও বিচ্ছেদ ঘটবে।

রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য এ দিন মমতার সরকার যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ২ সেপ্টেম্বর কোনও কর্মী অনুপস্থিত থাকলে তাঁর এক দিনের বেতন কাটা যাবে (ডায়েজ নন) এবং চাকরিজীবন এক দিন কমে যাবে। কর্মীদের হাজিরা নিশ্চিত করতে আগের রাতে সরকারি অফিসেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকী মহিলা কর্মীদেরও।

সরকারি বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সিটু-র রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী এ দিন জানান, বেতন কাটার যে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আইনত তা করা যায় না। আগের ধর্মঘটে যাঁদের বেতন কাটা হয়েছে, তাঁরা মামলা করেছেন। সেই মামলা এখনও চলছে। তাঁর দাবি, আগে টানা ৩৩ বছর কাজ করলে অবসরের পর পুরো পেনশন পাওয়া যেত। এখন তা হয় ২১ বছরে। কাজেই চাকরির মেয়াদ এক দিন কমে গেলেও কর্মীদের কোনও আর্থিক ক্ষতি হবে না।

তৃণমূল নেতৃত্ব এই ধর্মঘটকে শিল্পবিরোধী বলে প্রচার করলেও সিটু-র সাধারণ সম্পাদক তপন সেনের কথায়, ‘‘শ্রমিকরা এক দিন ধর্মঘট করেই পর দিন থেকে কাজে নামবে। তাতে শিল্পায়নে বাধা হয় না। মুখ্যমন্ত্রীর চ্যালাচামুণ্ডারা যে তোলাবাজি শুরু করেছেন, তাতেই শিল্প ব্যাহত হচ্ছে।’’ এআইটিইউসি নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যখন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সরকারের বৈঠক চলছে, তখনই কেন্দ্র ধর্মঘটের বিরুদ্ধে নির্দেশিকা জারি করছে।’’

ধর্মঘটীদের দাবিদাওয়া যখন দিল্লির কাছে, তখন এত সুর চড়ালেন কেন মুখ্যমন্ত্রী? রাজনীতিকদের একাংশের ব্যাখ্যা, সম্প্রতি নবান্ন অভিযানে বামেদের যে আগ্রাসী ভূমিকা দেখা গিয়েছে তার জেরেই তৃণমূল বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে। শাসক দলের অনেকেই মনে করেন, এই ধর্মঘট যদি সফল হয়, তা হলে আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে বামেরা ভাল মতো অক্সিজেন পেয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে সুর চড়িয়ে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখবে বামেরা। এটা উপলব্ধি করেই কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন মমতা।


বন্‌ধের বিরোধিতায় শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আইএনটিটিইউসি-র মিছিল।

তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন অভিযোগ করেন, শ্রমিকদের স্বার্থে ধর্মঘট ডাকা হয়নি। ডাকা হয়েছে, সিপিএম-সহ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক স্বার্থে। সিপিএম নেতৃত্ব চান, নবান্ন অভিযানের দিনের মতোই লাঠি, ঢিল নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করার আরও একটা সুযোগ নিতে। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমরা এই সত্যটা শ্রমিকদের বুঝিয়ে তাঁদের বুধবার কাজে যোগ দিতে বলব। জনগণের কাছেও আবেদন করব, ধর্মঘটের বিরোধিতা করার জন্য। তবে রাস্তায় নেমে সম্মুখ সমরে যেতে কাউকে বলব না।’’ ধর্মঘটের বিরোধিতা করে ধর্মতলায় এ দিন মিছিল করে আইএনটিটিইউসি। পথসভায় সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ধর্মঘট সমর্থকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘যিনি কাজে যেতে ইচ্ছুক, তাঁকে কেউ বাধা দিলে পুলিশ গিয়ে ব্যবস্থা নেবে।’’

ধর্মঘটী ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা এ দিন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দেন। তাঁরা জানান, রাজ্যপাল জানতে চেয়েছেন, দাবিগুলি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের জানানো হচ্ছে না কেন? তাঁরা বলেছেন, জানিয়ে লাভ হয়নি। তাই এ বার প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হচ্ছে। ধর্মঘটের সমর্থনে এ দিন ধর্মতলায় মিছিলও করেন বাম শ্রমিক নেতারা। আজ, মঙ্গলবারও রামলীলা ময়দান, শ্যামবাজার এবং ভিক্টোরিয়া হাউস থেকে ১৭টি বাম দলের মিছিল হবে। ধর্মঘট কি শান্তিপূর্ণ হবে? শ্যামল চক্রবর্তীর জবাব, ‘‘আমরা শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট চাই। অশান্তি হলে, শ্রমিকদের আঘাত করা হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে। আক্রমণ হলে সে দিন যা যা ঘটবে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।’’ ইউটিইউসি-র অভিযোগ, হাওড়ার ঘুসুড়ি বাজারে এ দিন তাদের জেলা সম্পাদক অলোক ঘোষের উপর তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা আক্রমণ করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ নবান্ন অভিযানের দিন পুলিশি দমনপীড়ন নিয়ে দিল্লিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম।

ধর্মঘট মোকাবিলায় প্রশাসনের তৎপরতাও তুঙ্গে। ধর্মঘটের দিন সর্বোচ্চ সংখ্যায় সরকারি বাস চলবে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে রাজ্য জানিয়েছে, উড়ান ওঠানামা স্বাভাবিক রাখতে সরকার সর্বতো ভাবে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে বিমানকর্মী, পাইলটদের নিরাপত্তাও দেবে রাজ্য। এ দিন ধর্মঘট মোকাবিলায় পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব। পরে পরিবহণ ভবনে সরকারি বাস নিগম, বেসরকারি বাস-মিনিবাস মালিক, ট্যাক্সি, অটো, পুলিশকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন পরিবহণসচিব। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হবে, যাতে কোনও ভাবেই ধর্মঘটী বলপ্রয়োগ করতে না-পারেন।’’ যাঁরা রাস্তায় গাড়ি বের করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও সরকার ভাবছে বলে জানিয়ে দিয়েছেন পরিবহণসচিব।

যদিও ধর্মঘটের দিন গাড়ি নামানোর কোনও নিশ্চয়তা দেয়নি বেসরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলি। ওলা, উবেরের রমরমা ঠেকাতে ২ সেপ্টেম্বর থেকে ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাকে অনড় রয়েছে টাক্সিমালিকদের সংগঠন বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন। বেসরকারি বাস-মিনিবাসের মালিকেরা গাড়ি বের করতে প্রস্তুত থাকলেও চালক-কন্ডাক্টরেরা থাকবেন কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই। এ দিনের বৈঠকে ছিলেন রেল পুলিশ ও রেল প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। তাঁরা রেল ও মেট্রো রেল চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

— নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE