Advertisement
০৬ মে ২০২৪
পুলিশ-তৃণমূল যুগলবন্দি

ব্লেড চালিয়ে, বিছুটি ঘষে নির্যাতন বধূকে

ডান হাতের তালুতে ধারালো কিছু দিয়ে চিরে দেওয়ার চিহ্ন তখনও তাজা। রক্ত শুকিয়ে লেগে রয়েছে সেই সব ক্ষতচিহ্নে। সারা গায়ে দাগড়া দাগড়া ছোপ। রবিবার বীরভূমের পাড়ুইয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে শুয়ে ভয়ে কেঁপে উঠছিলেন বছর বাইশের বধূটি। অভিযোগ, শনিবার রাতে তাঁর ভাশুরপোর খোঁজে আসে পুলিশ। না পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে ওই বধূকেই তুলে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতন চালিয়েছে তারা। বিজেপি সমর্থক পরিবারের উপর এমন আক্রমণের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের লোকজনও ছিল বলে অভিযোগ।

পাড়ুইয়ের সাত্তোরে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিতা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

পাড়ুইয়ের সাত্তোরে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিতা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

ডান হাতের তালুতে ধারালো কিছু দিয়ে চিরে দেওয়ার চিহ্ন তখনও তাজা। রক্ত শুকিয়ে লেগে রয়েছে সেই সব ক্ষতচিহ্নে। সারা গায়ে দাগড়া দাগড়া ছোপ।

রবিবার বীরভূমের পাড়ুইয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে শুয়ে ভয়ে কেঁপে উঠছিলেন বছর বাইশের বধূটি। অভিযোগ, শনিবার রাতে তাঁর ভাশুরপোর খোঁজে আসে পুলিশ। না পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে ওই বধূকেই তুলে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতন চালিয়েছে তারা। বিজেপি সমর্থক পরিবারের উপর এমন আক্রমণের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের লোকজনও ছিল বলে অভিযোগ।

বীরভূমে বিজেপি-র উত্থান যে অঞ্চল থেকে, সেই পাড়ুইয়ের সাত্তোর এলাকায় শ্বশুরবাড়ি ওই বধূর। দিন কয়েক আগে তিনি বর্ধমানের বুদবুদ থানার কলমডাঙা গ্রামে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বোমাবাজির ঘটনায় অভিযুক্ত তাঁর এক ভাশুরপোকে ধরতে শনিবার সন্ধেয় ওই গ্রামেই হানা দেয় বীরভূম জেলা পুলিশের একটি বিশেষ দল। অভিযোগ, অভিযুক্তকে না পেয়ে পুলিশ তার কাকিমাকে (ওই বধূ) তুলে নিয়ে গিয়ে রাতভর নির্যাতন চালিয়েছে। বধূর পরিবারের দাবি, বীরভূম জেলা পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের (এসওজি) ওসি কার্তিকমোহন ঘোষের নেতৃত্বেই ওই অত্যাচার চালানো হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে পাড়ুইয়ের দাপুটে তৃণমূল নেতা শেখ মুস্তফা ও তাঁর দলবলও ছিল বলে দাবি করছেন নির্যাতিতা। বধূর শাশুড়িও বলেন, “বৌমা আমাদের বলেছে, শেখ মুস্তাফা, আসগর আর ওদের দলবল পুলিশকে আরও অত্যাচার চালাতে বলছিল। এর পর আর পুলিশে ভরসা থাকে?”

বধূ জানিয়েছেন, অত্যাচারের পরে পুলিশ তাঁকে বেহুঁশ অবস্থায় বীরভূমের ইলামবাজার থানায় রেখে যায়। দায় ঝেড়ে ফেলতে রবিবার সকালে এক আত্মীয়কে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় বধূকে। ওঁরা প্রথমে বধূর বাপের বাড়িতে যান। সেখান থেকে তাঁকে সাত্তোরে ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বামী। তার পরেই বধূকে ভর্তি করানো হয় সিউড়ি সদর হাসপাতালে। রবিবার রাতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ঘটনার অভিযোগ সরাসরি উড়িয়ে দেননি জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া। তাঁর বক্তব্য, “এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছেই ওই মহিলাকে অত্যাচারের অভিযোগ জানতে পারি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি। মহিলার পরিবার লিখিত অভিযোগ করলে তারও তদন্ত করা হবে।” তবে প্রাথমিক ভাবে এসপি-র বক্তব্য, ওই মহিলার ভাশুরের ছেলে মিঠুন শেখের বিরুদ্ধে পাড়ুই থানায় বোমাবাজি-সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের কাছে খবর ছিল, সম্প্রতি পায়ে চোট পেয়ে মিঠুন কলমডাঙা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। তাই পুলিশ ওই এলাকায় গিয়েছিল। এসপি বলেন, “ওই বধূর বাড়িতে তল্লাশি করা হয়। এক মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।”

রবিবার রাতে পাড়ুই থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন নির্যাতিতার স্বামী। যদিও সংবাদমাধ্যমের কাছে দেওয়া নির্যাতিতার বক্তব্যের সঙ্গে এফআইআরের বয়ানে বেশ কিছু ফারাক রয়েছে। নির্যাতিতা ও তাঁর বাড়ির একাধিক সদস্য শেখ মুস্তফার নাম নিলেও এফআইআরে ওই তৃণমূল নেতার নাম নেই। বরং নাম রয়েছে, তাঁর ছেলে শেখ আসগর-সহ (পাড়ুইয়েরই সাগর ঘোষ হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত এবং পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ফেরার) বেশ কিছু তৃণমূল কর্মীর। পুলিশ অফিসার কার্তিকবাবুর নেতৃত্বেই যে অত্যাচার হয়েছে, সে কথা এফআইআরে আছে।

এ দিন সাত্তোরে গিয়ে দেখা যায়, গোটা পাড়া ভেঙে পড়েছে নির্যাতিতার বাড়ির উঠোনে। পুলিশের উপরে ক্ষোভে ফুঁসছেন গ্রামবাসীরা। উঠোনে শুয়ে ছিলেন নির্যাতিতা। কথা বলতে যেতেই ডান হাতের রক্তাক্ত তালু দেখালেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “প্রচণ্ড মেরেছে। দু’টো লাঠি মারতে মারতে ভেঙেই ফেলল পুলিশগুলো! হাতের তালুও চিরে দিল।” নির্যাতিতার বড় জা-র (মিঠুনের মা) কথায়, “আমি তো গ্রামেই আছি। পুলিশ আমার বাড়িতে বারবার এসে ভাঙচুর করেছে। পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারত। এ ভাবে ছোট জা-কে কেন ওরা মারধর করল, তা বুঝতে পারছি না।”

কী ভাবে ঘটে গেল এ সব?

পুলিশের একটি সূত্রের খবর, ওসি (এসওজি) কার্তিকমোহন ঘোষের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল শনিবার প্রথমে সাত্তোরে শেখ মিঠুনের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। পরে তারা যায় কলমডাঙায়। নির্যাতিতার দাবি, “আমি বাপের বাড়িতেই ছিলাম। পুলিশ এসে নাম জিজ্ঞেস করল। নাম বলতেই ওদের সঙ্গে থাকা তৃণমূল নেতা শেখ মুস্তফা আর তার লোকেরা পুলিশকে বলল, ‘একে গাড়িতে তোল, সব বেরিয়ে আসবে!’ শুনেই আমাকে মারতে মারতে টেনে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলল পুলিশ।”

কোনও মহিলা পুলিশ ছিলেন না বলেই নির্যাতিতার দাবি। কলমডাঙার বাড়িতে নির্যাতিতার মা-ও বলেন, “আমার মেয়ে তো কোনও দোষ করেনি। শনিবার পুলিশ জোর করে ওকে তুলে নিয়ে গেল।”

এর পরের অভিযোগ আরও ভয়ঙ্কর। বধূ বলতে থাকেন, “তিনটি গাড়িতে ওরা এসেছিল। পাশের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে আমায় গাছের সঙ্গে বাঁধল। ‘মিঠুন কোথায়, তুই লুকিয়ে রেখেছিস’ বলতে বলতে পেটাতে শুরু করল।” বধূর কথায়, “আমার আঙুল ভেঙে দেয় ওরা। আমি বলি, ‘মেরো না। আমি কিছু জানি না’। পুলিশ শোনেনি। শাড়ি-ব্লাউজ ছিঁড়ে দেওয়া হয়।” মারের চোটে বধূটি জ্ঞান হারান। তা-ও রেহাই মেলেনি। মহিলার কথায়, “চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায় ওরা। গোটা শরীরে বিছুটি পাতা ঘষে দেয়। ধারালো কিছু দিয়ে হাত চিরে দেওয়া হয়। যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে ফের বেহুঁশ হয়ে পড়ি। এর পরে যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি থানার মধ্যে আছি।”

জেলা পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্রেও জানা যাচ্ছে, শনিবার রাতে অজয় নদ পেরিয়ে ইলামবাজার থানায় ওই বধূকে রেখে চলে যায় এসওজি। থানা প্রথমে ওই মহিলাকে রাখতে চায়নি। কিন্তু নিচু তলার পুলিশকর্মীদের আপত্তিকে এসওজি আমল দেয়নি। খবর পেয়ে রাতেই থানায় চলে আসেন জয়দেব-কেঁদুলি মেলার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইলামবাজার থানার ওসি। নির্যাতিতার দাবি, রবিবার সাদা কাগজে টিপসই করিয়ে এক আত্মীয়ের হাতে তাঁকে তুলে দেয় পুলিশ।

ঘটনায় যাঁর দিকে অভিযোগের মূল তির, বীরভূম পুলিশের সেই ওসি (এসওজি) কার্তিকমোহন ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফার দাবি, “শনিবার আমি বাড়িতেই ছিলাম। এই ঘটনায় তৃণমূলের কেউ জড়িতও নয়।” তাঁর ছেলে আসগরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বারবার ফোন করা হলেও ধরেননি জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।

বুদবুদ থানার তরফে বলা হয়েছে, শনিবারের ওই তল্লাশি অভিযানের ব্যাপারে বীরভূমের পুলিশ তাদের কিছু জানায়নি। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “তল্লাশি হলে সাধারণত সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে কথা বলে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছিল আমি জানি না। তবে, আমার কাছে কোনও খবর ছিল না।”

ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “এটা বর্বরোচিত ঘটনা। ওই মহিলাকে নির্যাতনের সময় পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্তও পুলিশের সঙ্গে ছিল।” বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারের প্রতিক্রিয়া, “তৃণমূল ও তাদের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী মিলে যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার নিদর্শন রেখেছে, তা নিন্দার ভাষা নেই।” ঘটনাস্থলে প্রতিনিধি পাঠিয়ে তদন্তের জন্য জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনকে অনুরোধ করেছেন রাহুল। আজ, সোমবার তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি-র প্রতিনিধিদল রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে সব জানাবে। নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াতে আর একটি প্রতিনিধিদল যাবে পাড়ুইয়ে। ঘটনার প্রতিবাদে কলেজ স্কোয়ার থেকে আজ প্রতিবাদ মিছিলও করবে দলের মহিলা মোর্চা।

নিন্দায় সরব অন্য বিরোধী দলগুলিও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, “এমন নৃশংসতা দলমত নির্বিশেষে কেউই মেনে নিতে পারেন না। তৃণমূলের জনসমর্থন যত কমছে, তত তারা ভাবছে অত্যাচার করে জবরদস্তি করে সব ধরে রাখবে।” এ দিন সিউড়ি হাসপাতালে নির্যাতিতার সঙ্গে দেখাও করেন সিপিএমের বীরভূম জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোম।

কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “মধ্যযুগীয় বর্বরতার কলঙ্ককেও ছাপিয়ে গিয়েছে এই ঘটনা। ভাবতে অবাক লাগে, এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা আর তাঁরই দফতরের স্তাবক পুলিশ তৃণমূলের পদলেহন করার জন্য এই কাণ্ড করেছে!” উত্তরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “আমরা হিংসার রাজনীতি সমর্থন করি না। রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের মোকাবিলা করতে না পেরে বিজেপি এখন হিংসা-কুৎসার আশ্রয় নিয়েছে।” কোনও অভিযোগ থাকলে প্রশাসন তদন্ত করবে বলে জানান পার্থবাবু।

(সহ-প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত, সুব্রত সীট)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE