Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
হুমকি-কাণ্ডে এ বার বিভাগীয় প্রধানকে সরানোর দাবি

বিশ্ববিদ্যালয়ে নাক গলিয়ে প্রশ্ন তৃণমূলেই

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুমকি-কাণ্ড নিয়ে ফের আসরে নামল তৃণমূল। দাবি তুলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায়কে অপসারণের। এই ঘটনায় ফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসকদলের ‘অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ’-এর অভিযোগ তুলেছেন অধ্যাপকদের একাংশ।

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘরে তৃণমূল নেতারা।

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘরে তৃণমূল নেতারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৩
Share: Save:

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুমকি-কাণ্ড নিয়ে ফের আসরে নামল তৃণমূল। দাবি তুলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায়কে অপসারণের। এই ঘটনায় ফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসকদলের ‘অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ’-এর অভিযোগ তুলেছেন অধ্যাপকদের একাংশ।

গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপক রঞ্জন মণ্ডলকে স্মারকলিপি দেয় ‘পুরুলিয়া নাগরিক সমাজ’। যদিও ঘটনা হল, এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন তৃণমূলের পুরুলিয়া শহর কমিটির সভাপতি তথা পুরুলিয়ার পুরসভার কাউন্সিলর বৈদ্যনাথ মণ্ডল, দলের জেলা কমিটির নেতা মানিকমণি মুখোপাধ্যায় এবং শাসকদলের আরও কিছু নেতা ও কাউন্সিলর। সূত্রের খবর, এ দিন তাঁরা উপাচার্যের কাছে দাবি তোলেন, দলবিরোধী (তৃণমূল বিরোধী) কার্যকলাপ চালানো ওই অধ্যাপককে যেন উপাচার্য প্রশ্রয় না দেন। পাশাপাশি, বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দনগর ক্যাম্পাসে কিছু বহিরাগত এসে অধ্যাপকদের একাংশের বৈঠক হুমকি দিয়ে বৈঠক ভন্ডুল করার যে অভিযোগ পুলিশের কাছে গৌতমবাবু করেছেন, তাকেও কোন ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।

এ দিন অবশ্য ক্যাম্পাসে যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশকর্মী উপস্থিত ছিলেন। নাগরিক মঞ্চের প্রতিনিধিরা যখন স্মারকলিপি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন ক্যাম্পাসের গেটের বাইরে থাকা মঞ্চের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আসা তৃণমূল কর্মীরা সোৎসাহে ‘বৈদ্যনাথ মণ্ডল জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগানও দেন। মানিকমণিবাবুর অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধানের কিছু আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাই তাঁকে সতর্ক করে দেওয়ার কথা এ দিন উপাচার্যকে বলতে এসেছিলেন তাঁরা।

বৈদ্যনাথবাবু বলেন, ‘‘আমরা উপাচার্যকে বলেছি, গৌতমবাবু কিছু বিধিবহির্ভূত কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই বিষয়ে আপনাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’’ নাগরিক সমাজের আর এক প্রতিনিধি দোলন ঘোষের মন্তব্য, ‘‘উপাচার্যকে উল্টোপাল্টা জিনিসে প্রশ্রয় দিতে আমরা বারণ করেছি।’’এক ধাপ এগিয়ে কেউ কেউ গৌতমবাবুকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন।

তৃণমূল নেতাদের এ ভাবে সরাসরি উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এক বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে অধ্যাপকদের বড় অংশের মনে। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতাতেও ভুগছেন। বুধবারই তাঁরা উপচার্যের কাছে নিরাপত্তার দাবিতে স্মারলকিপি দিয়েছেন। তাঁদের প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে শাসকদল কেন এ ভাবে নাক গলাবে? গৌতমবাবুকে অপসারণের দাবি প্রসঙ্গে উপাচার্যও নিজেও বলেছেন, ‘‘বললেই তো হয় না, সব কিছুরই তো একটা পদ্ধতি রয়েছে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

স্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসছেন শাসকদলের কর্মীরা।

বস্তুত, এই গোটা ঘটনা তৃণমূলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সংগঠন ওয়েবকুপার অন্তদ্বর্ন্দ্বেরই পরিণাম বলে জানা যাচ্ছে। যার এক দিকে রয়েছেন, সংগঠনের রাজ্য কমিটির সহ-সম্পাদক গৌতম মুখোপাধ্যায়। অন্য দিকে, সংগঠনের তরফে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সভানেত্রী তথা রসায়ন বিভাগের অধ্যাপিকা সাধনা খাওয়াস। এই ঘটনায় এমনকী, জেলা তৃণমূলের অন্দরেও প্রশ্ন উঠেছে। পুরুলিয়ার বর্ষীয়ান তৃণমূল বিধায়ক তথা পুরপ্রধান কে পি সিংহদেও মনে করছেন, এই ঘটনায় দলের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমি অসুস্থ। তবে, ঘটনার কথা জেনেছি। আমাদেরই সংগঠনের (ওয়েবকুপা) দুই নেতা-নেত্রীর বিবাদ থাকলে সংগঠন বা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তাঁদের কাছ থেকে রিপোর্ট চাওয়া যেতে পারত। দলের একটি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি আছে। নিয়মকানুনও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের হস্তক্ষেপ ঠিক নয়। জেলা সভাপতির বিষয়টি দেখা উচিত।’’ এ দিন বৈদ্যনাথবাবুদের স্মারকলিপি দেওয়ার পরে উপাচার্যের কাছে যান স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য তথা কর্মাধ্যক্ষ উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌতম রায়। দু’জনেই বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ, শিক্ষাঙ্গনে বাইরের লোকজনের হস্তক্ষেপ চলবে না।’’

জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, ‘‘আমি কলকাতায় রয়েছি। ঠিক কী হয়েছে, জানা নেই। তবে, বিশদে খোঁজ নিচ্ছি।’’ জেলা তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, এ দিন যে নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জেলা সভাপতির অনুগামী।

বহিরাগতেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যাপকদের হুমকি দিয়েছে ও বৈঠক ভন্ডুল করে দিয়েছে—এই মর্মে গৌতমবাবু বৃহস্পতিবার পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন। তাতে যে পাঁচ জনের নাম ছিল, তাঁদের অন্যতম তৃণমূলের কৃষক সংগঠনের নেতা সুদীপ মাহাতো। এ দিন আবার গৌতমবাবুর বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন সাধনাদেবী। তাঁর দাবি, গৌতমবাবু অন্য বিভাগের অধ্যাপকদের বৈঠকে ডাকছেন। না এলে হুমকি দিচ্ছেন। এটা তাঁর এক্তিয়ার বহির্ভূত। সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রী হিসেবে তিনি তাই অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ উড়িয়ে গৌতমবাবু বলেন, ‘‘বুধবার বৈঠকে অধ্যাপকদের আসার জন্য একটা মেল পাঠিয়েছিলাম মাত্র। সেই বার্তায় অনুরোধ ছিল, হুমকি নয়। একেবারেই ভিত্তিহীন অভিযোগ।’’ নাগরিক সমাজের নামে তাঁর বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কারা আমি জানি না। তবে যা শুনেছি, যাঁরা বুধবার বাইক বাহিনী নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে হুমকি দিয়েছিল, এই নাগরিক মঞ্চ তাঁদের প্রতিনিধি!’’ বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা দেখার জন্য তো আচার্য, উপাচার্য, সবোর্পরি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী রয়েছেন বলেও গৌতমবাবুর অভিমত।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বামেদের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটার পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক বাবর আলি মির্ধারও বক্তব্য, ‘‘এটা ওয়েবকুপার দুই নেতা-নেত্রীর লড়াই। কিন্তু, তাঁরা দু’জনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেই দ্বন্দ্বে বহিরাগতরা কেন নাক গলাবে? এটা কখনওই কাম্য নয়।’’ তাঁর অভিযোগ, সবে পুরুলিয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত সব পক্ষের। অথচ শাসকদলের লড়াই এখনই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE