Advertisement
০২ মে ২০২৪

বাহা থেকে হিরণ, কন্যাশ্রীর মঞ্চও তারা-ঝলমলে

স্কুলে পড়া মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বিপদ নিয়ে তখন সবে বলতে শুরু করেছেন এ দেশে ইউনিসেফের প্রধান লুই জর্জ আর্সেনল। প্রবল হাততালিতে তাঁর স্বর চাপা পড়ে গেল। ঠিক তখনই মঞ্চে উঠছেন টালিগঞ্জের দুই তরুণ নায়ক সোহম ও হিরণ। সোহম সামনে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রদের ঢিপঢিপিয়ে প্রণাম শুরু করে দিতে ইউনিসেফ-প্রতিনিধি ‘বলব-কি-বলব না’ দ্বিধায় বেশ খানিক ক্ষণ ভ্যাবাচাকা তাকিয়ে থাকলেন।

‘কন্যাশ্রী দিবস’-এর অনুষ্ঠানের মঞ্চে টলিউড শিল্পীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টোডিয়ামে। —নিজস্ব চিত্র

‘কন্যাশ্রী দিবস’-এর অনুষ্ঠানের মঞ্চে টলিউড শিল্পীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টোডিয়ামে। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

স্কুলে পড়া মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বিপদ নিয়ে তখন সবে বলতে শুরু করেছেন এ দেশে ইউনিসেফের প্রধান লুই জর্জ আর্সেনল। প্রবল হাততালিতে তাঁর স্বর চাপা পড়ে গেল।

ঠিক তখনই মঞ্চে উঠছেন টালিগঞ্জের দুই তরুণ নায়ক সোহম ও হিরণ। সোহম সামনে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রদের ঢিপঢিপিয়ে প্রণাম শুরু করে দিতে ইউনিসেফ-প্রতিনিধি ‘বলব-কি-বলব না’ দ্বিধায় বেশ খানিক ক্ষণ ভ্যাবাচাকা তাকিয়ে থাকলেন।

একটি বহুজাতিক সংস্থার সিইও (দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া) বি ডি পার্ক-এর বক্তৃতার ফাঁকে আসরে এলেন ছোট পর্দার ‘ঝিলিক’ (তিথি), অপরাজিতা আঢ্যেরা। গ্যালারির স্কুলবালিকা, তরুণীদের উচ্ছ্বাস থামা পর্যন্ত বক্তা ফের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন। পার্ক-এর ফাঁকা আসনেও ভুল করে বসে পড়েছিলেন ‘ঝিলিক’। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস তাঁকে চুপিচুপি সরিয়ে নিয়ে গেলেন।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বেও মিমি, সায়ন্তিকা, রাজ চক্রবর্তী প্রমুখকে ঢুকতে দেখা গেল। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা: ‘জ্বর হয়েছে বলে দেব আসতে পারছে না’। তাতেও হাততালির ঝড়! বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ‘কন্যাশ্রী দিবস’-এর অনুষ্ঠানে টালিগঞ্জের ফিল্ম-টিভির তারকারাই কার্যত প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন।

মঞ্চের পিছনে ফুটফুটে তিন স্কুলবালিকার হাসিমুখ। সামনে মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে শুভশ্রী, তনুশ্রী, জুন, লকেট, রণিতা (বাহা), রুদ্রনীল থেকে শ্রীকান্ত মোহতারা। সবাই মিলে ‘কন্যাশ্রী’ লোগো আঁকা সন্দেশের কেক কাটলেন। আলাদা করে তাঁর ‘প্রিয় চিত্রতারকা বন্ধুদের’ সকলের নাম করে ধন্যবাদ জানিয়ে উপহারও দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

রাজ্য সরকারের উত্তমকুমার পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ, লালবাজারের ‘জয় হো’-র আসর কিংবা কলকাতায় পুর উদ্যোগে কেকেআর-এর সংবর্ধনা-মঞ্চেও সাধারণত এই চেনা মুখগুলোরই দেখা মেলে। বাস্তবিক, গণবিনোদনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী তারকাদের জৌলুসই এ দিন কন্যাশ্রীর মূল সুরটাও বেঁধে দিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলেও দফায় দফায় তারকা-অতিথিদের আবির্ভাব চলছে একেবারে শেষ পর্যন্ত। তাতে কখনও বক্তৃতা থমকে গিয়েছে। কখনও বা নতুন করে অতিথিদের উপহার প্রদানের হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছে। এই ‘ছন্দপতন’ যে খুব অভিপ্রেত ছিল না, সরকারি কর্তারাও ঠারেঠোরে তা মেনে নিচ্ছেন।

তবে ওই কর্তাদেরই বক্তব্য, রাজ্য জুড়ে কন্যাশ্রীর মাধ্যমে সাড়া ফেলতে কৌশল হিসেবে শুরু থেকেই চিত্রতারকাদের গ্ল্যামারকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কন্যাশ্রীর প্রথম বছরের বিজ্ঞাপনের মুখ ছিলেন প্রসেনজিৎ। এক সরকারি কর্তার মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী জনতার ‘পাল্স’ (নাড়ি) খুব ভাল বোঝেন। আর ওঁর উৎসাহ ও কৌশলে প্রকল্পটির লাভও হয়েছে।” সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, গত ১০ মাসে কন্যাশ্রীর আওতায় প্রায় ১৬ লক্ষ মেয়েকে নিয়ে আসা গিয়েছে। দেশের যে-কোনও প্রকল্পের সাফল্যের নিরিখে এই সংখ্যাটা খুব কম নয়।

এ দিন সব মেয়েকে শপথবাক্য পড়ান সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনী সেন। কী ছিল শপথবাক্যে? ছিল ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বিয়ে না-করা এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। স্বনির্ভর হতে দৃঢ় ভাবে চেষ্টা করার কথাও বলল মেয়েরা। বার্ষিক এক লক্ষ ২০ হাজারের নীচে আয়, এমন পরিবারের ১৩-১৮ বছরের মেয়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বছরে ৫০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। পড়াশোনা চালিয়ে গেলে ১৮ বছরের পরে তাঁরা পাবেন, এককালীন ২৫ হাজার টাকা। রোশনীর কথায়, “গরিব ঘরের নাবালিকা জনসংখ্যার একটা হিসেবও আমরা এখন হাতে পাচ্ছি। এর ফলে মেয়ে পাচার রুখতে সুবিধা হবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মেয়েদের ক্ষমতায়নেও কিছু সুরাহা হবে।” তবে যাদের জন্য প্রকল্প, তাদের কারও কারও কাছে টাকা পৌঁছতে দেরি হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এই প্রকল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়েই ইউনিসেফের দেড় কোটি টাকা অর্থসাহায্যে অন্য একটি সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়েছে। কন্যাশ্রী রূপায়ণের ভিত্তিতে ওই প্রকল্পে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কম বয়সে বিয়ে সংক্রান্ত নথি তৈরি করা হবে। তরুণদের পেশাগত দক্ষতার বিকাশে স্যামসাং সংস্থার সঙ্গে রাজ্য সরকারের একটি ‘মউ’ বা সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতেও সুবিধা হবে কন্যাশ্রীদের। ৫০০টি উন্নত বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমে ৩০ শতাংশ আসনে পরিচয়পত্রধারী কন্যাশ্রীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। রাজ্যের বিভিন্ন আইটিআই, পলিটেকনিকে ভর্তির সময়েও অর্ধেক টাকা ছাড় পাবেন কন্যাশ্রীরা।

এ-সবের সঙ্গে মেয়েদের সোনার জল দেওয়া ‘কন্যাশ্রী বালা’ও পরিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার সঙ্গে সবুজ চিরকুটে লেখা ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপহার’। নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানটির সাক্ষী ১০ হাজার ছাত্রী। সরকারি সূত্রের খবর, খরচ হয়েছে প্রায় ১৯ লক্ষ টাকা। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, নেপালি, সাঁওতালির মতো ভাষায় এই প্রকল্প নিয়ে কবিতা লিখেও পুরস্কার পেয়েছেন মেয়েরা। এ ছাড়া জেলায় জেলায় বিভিন্ন ব্লকে বসেছিল কন্যাশ্রীর আসর। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এ দিন একসঙ্গে প্রায় চার লক্ষ মেয়ের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।

এ বার থেকে ১৪ অগস্টই হবে ‘কন্যাশ্রী দিবস’। তাই তাঁর ‘ছোট্ট গার্লচাইল্ড বন্ধুদের’ উদ্দেশে মমতার সম্ভাষণ: ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে’। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সারা পৃথিবীতে কোথাও এমন হয় না!” নিজের লেখা কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েও মেয়েদের উৎসাহ দেন মুখ্যমন্ত্রী। এই মেয়েরা এক দিন দেশ চালাবে, বিশ্বকে পথ দেখাবে বলে মমতার আবেগমথিত উচ্চারণ: “তোমরা ভোরের উষা, শরতের শিউলি, বসন্তের ফাগুন ও বিশ্বের আগুন।”

এই প্রকল্প চাই দেশ জুড়ে: মেনকা

গোটা দেশের জন্যই ‘কন্যাশ্রী’র ধাঁচে প্রকল্প গড়ার কথা ভাবছে কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার লোকসভায় এ কথা জানান কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী। নারী-নির্যাতন নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেনকা বলেন, “কন্যাশ্রী একটি দারুণ চিন্তা। আমরা এই ধরনের প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে কাজ করতে পারি।” প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে ঠেকাতে বা মেয়েদের ক্ষমতায়নে কন্যাশ্রীর মতো উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে বলে মনে করছে কেন্দ্র। মহিলা কমিশনকেও আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। গুজরাত ও দিল্লির ধাঁচে মেয়েদের জন্য ২৪ ঘণ্টার একটি হেল্পলাইন চালু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kanyashree project baha hiran mamata bandyopadhya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE