Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মাখড়া কাণ্ডে গ্রেফতার বহিরাগতেরা, চাপান-উতোর শুরু দু’দলে

চারটি মামলায় গ্রেফতার ১০। তাদের মধ্যে পাড়ুই থানা এলাকার বাসিন্দা মাত্র দু’জন। বাকিদের মধ্যে পাঁচ জন অন্য ব্লকের। তিন জন থাকে ইলামবাজারের (মাখড়া এই ব্লকেই পড়ে) অন্যত্র। ধৃতদের মধ্যে আট জনই শাসক দলের কর্মী বলে পরিচিত। দু’জন বিজেপি-র কর্মী। বুধবার এই ধরপাকড়ের পরে বাইরে থেকে লোক এনে হামলার যে অভিযোগে এলাকাবাসী সরব হয়েছিলেন, তা আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে নানা মহলে।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৪৬
Share: Save:

চারটি মামলায় গ্রেফতার ১০। তাদের মধ্যে পাড়ুই থানা এলাকার বাসিন্দা মাত্র দু’জন। বাকিদের মধ্যে পাঁচ জন অন্য ব্লকের। তিন জন থাকে ইলামবাজারের (মাখড়া এই ব্লকেই পড়ে) অন্যত্র। ধৃতদের মধ্যে আট জনই শাসক দলের কর্মী বলে পরিচিত। দু’জন বিজেপি-র কর্মী। বুধবার এই ধরপাকড়ের পরে বাইরে থেকে লোক এনে হামলার যে অভিযোগে এলাকাবাসী সরব হয়েছিলেন, তা আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে নানা মহলে।

বিজেপি-র বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল বলেন, “প্রথম থেকেই বলছি, বাইরে থেকে দুষ্কৃতীদের জড়ো করে তৃণমূল মাখড়া পুনর্দখলে নেমেছিল। পুলিশ লোকজনকে ধরার পরে সে কথাই প্রমাণিত হল।” কিন্তু বিজেপি-র যে দুই কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের বাড়িও তো মাখড়ায় নয়? বিজেপি নেতার জবাব, “ওরা একেবারেই লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দা।”

মাখড়া-কাণ্ডে এ পর্যন্ত চারটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে (পুলিশের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা ও নিহত তিন জনের পরিবারের তিন এফআইআর)। এ দিন সিউড়ি আদালতে বিচারক ধৃতদের পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে।”

পুলিশ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে দুবরাজপুর, ইলামবাজার ও পাড়ুই থানা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ২০ জনকে আটক করা হয়। যে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয় তার মধ্যে অভিযুক্তের তালিকায় শেখ সিরাজুল আর শেখ হাসিবুল ছাড়া, আর কারও নাম ছিল না। হাসিবুল নৌশণ্ডার (মাখড়া থেকে দূরত্ব ৬-৭ কিলোমিটার) ও সিরাজুল ইলামবাজারেরই বাসিন্দা। মোজাম্মেল শেখের হত্যায় হাসিবুল এবং তৌসিফ খুনে সিরাজুল অভিযুক্ত। ইলামবাজারের অন্যত্র ধরা হয়েছে আলি জিন্না (ভগবতীবাজার), রহমতুল্লাহ (আখনা) ও বজলে রহমান-কে (গোলাপবাগ)। গোলাপবাগ পাড়ুই থানা এলাকায়, মাখড়া গ্রামের গায়েই। আখনা ও ভগবতীবাজার পড়ে ইলামবাজার থানা এলাকায়।

বাকিদের মধ্যে চার জনের (শেখ আতাউল হক, শেখ আব্বাসউদ্দিন, মহসিন আখতার ও লাইসুর হক) বাড়ি দুবরাজপুরের পদুমা পঞ্চায়েত এলাকার খণ্ডগ্রামে। সাত্তার মোল্লার বাড়ি দুবরাজপুরের সালুঞ্চি গ্রামে। মাখড়া থেকে দুবরাজপুরের ওই গ্রামগুলির দূরত্ব প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার। হাসিবুল ও বজলে রহমান ছাড়া বাকিরা এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। বস্তুত ইলামবাজার ব্লকের মঙ্গলডিহি (মাখড়া এই পঞ্চায়েতেই পড়ে) ও বাতিকার এবং দুবরাজপুরের পদুমা ও যশপুর এই চারটি পঞ্চায়েত এলাকা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে। নদী বা খাল পেরিয়ে সহজেই এখান থেকে ওখানে ঢুকে পড়া যায়।

গত ভোটে চারটি পঞ্চায়েতেই তৃণমূল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর থেকে দলের অন্দরে কোন্দল বাড়ে। এই পঞ্চায়েতগুলির মধ্যেই কানুর, ডোমনপুর, চৌমণ্ডলপুর, মাখড়ার মতো বহু গ্রামে বিজেপি-তে যাওয়ার ঝোঁক বাড়ে। বিজেপি নেতা দুধকুমারের অভিযোগ, “একের পরে এক গ্রাম হাতছাড়া হওয়ায় মাথা ঠিক রাখতে পারেননি তৃণমূলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি জাফারুল ইসলাম। তাই ঘরছাড়াদের ফেরানোর অজুহাতে বহিরাগতদের দিয়ে মাখড়ায় এই হামলা করিয়েছেন।”

যদিও তৃণমূল শিবিরের দাবি, ঈদের মাসখানেক আগে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাখড়ার বেশ কিছু বাসিন্দা ‘কোণঠাসা’ করেছিলেন মোজাম্মেল শেখের মতো গুটিকয়েক তৃণমূলী পরিবারকে। জাফারুল ইসলামের অভিযোগ, তার পরেই মোজাম্মেল-সহ ১৪ জন তৃণমূল কর্মীর পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়। মাখড়ার বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, তাদের ফেরাতেই হামলা হয়েছে।

দুবরাজপুরের যে সালুঞ্চি ও খণ্ডগ্রাম থেকে দশ জনেরও বেশি তৃণমূল কর্মীকে পুলিশ আটক (পরে পাঁচ জন গ্রেফতার হয়) করেছে, সেখানে শাসক দলের অন্যতম নেতা শেখ গিয়াসউদ্দিন। জাফারুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভাল। বিজেপির দাবি, জাফারুলের অনুরোধে গিয়াসউদ্দিন দুবরাজপুর থেকে হামলার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। যে দলটি হামলায় এসেছিল, তার প্রথম সারিতেই ছিল নিহত শেখ সোলেমান, লাল বাস্কের (জখম হয়ে বর্ধমান মেডিক্যালে) মতো তৃণমূলের ‘কাজের লোকেরা’।

ধৃতদের দলের কর্মী বলে মেনে নিলেও মাখড়ার ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই বলেই দাবি করছেন গিয়াসউদ্দিন। তাঁর মন্তব্য, “নিরীহ লোকগুলোকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল।” একই সুরে জাফারুল বলেন, “বিজেপি মনের মাধুরী মিশিয়ে যা খুশি বলে যাচ্ছে। হামলায় তো ওদের বহিরাগতেরাও ছিল। না হলে আর পুলিশ তাদের ধরল কেন?” তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে একাধিক বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। অন্য কেউ তাঁর ফোন ধরে বলেন, “দাদা কথা বলবেন না।”

নিহতদের মৃতদেহ নিতে বর্ধমান মেডিক্যালে এ দিন ভিড় করেছিলেন মাখড়ার বাসিন্দারা। সেখানে শেখ তৌসিফ আলির কাকা আব্দুল সাত্তারের পাশেই বসেছিলেন আর এক নিহত শেখ মোজাম্মেলের আত্মীয় শেখ মুশারফ। দু’জনের গলাতেই শোনা গেল আক্ষেপ, “রাজনীতিই আমাদের পরিবারগুলো শেষ করে দিল! বাইরে থেকে আসা লোকেদের ফাঁদে আর পা দেব না।”

সহ প্রতিবেদন: রানা সেনগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dayal sengupta rana sengupta suri makhra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE