Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
জবাব এড়িয়ে আক্রমণ

মোদী ক্ষমা চান, নইলে মামলা: তৃণমূল

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি কে, কত টাকায় কিনেছেন রবিবার রাজ্যে এসে প্রশ্ন তুলেছেন নরেন্দ্র মোদী। সোমবার সেই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। বরং মোদীর প্রশ্নকে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমা চাইতে বললেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে। মোদী ক্ষমা না-চাইলে তাঁর নামে মানহানির মামলা করারও হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি অভিযোগ দায়ের করেছেন নির্বাচন কমিশনেও।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি কে, কত টাকায় কিনেছেন রবিবার রাজ্যে এসে প্রশ্ন তুলেছেন নরেন্দ্র মোদী। সোমবার সেই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। বরং মোদীর প্রশ্নকে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমা চাইতে বললেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে। মোদী ক্ষমা না-চাইলে তাঁর নামে মানহানির মামলা করারও হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি অভিযোগ দায়ের করেছেন নির্বাচন কমিশনেও।

রবিবার সন্ধ্যায় শ্রীরামপুরে নির্বাচনী সভায় মোদী বলেন, “প্রথমে মমতার ছবি বিক্রি হতো চার লাখে। পরে বেড়ে হয় ৮ ও ১৫ লাখ। শেষ পর্যন্ত মমতা এত ভাল ছবি আঁকতে আরম্ভ করলেন যে, ১ কোটি ৮০ লাখে তা বিক্রি হল! কে কিনল? মানুষের তা জানার অধিকার আছে।”

মোদীর জনসভার ১২ ঘণ্টার মধ্যে তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন তৃণমূল নেতৃত্ব। উপস্থিত ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র তথা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তাঁরা দাবি করেন, মোদী ভুল কথা বলছেন। মুকুলবাবু বলেন, “১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় ছবি কেনার গল্প হচ্ছে। উনি (মোদী) যে অভিযোগ করছেন, তা প্রমাণ করুন! না হয় নিঃশর্ত ক্ষমা চান।” কিন্তু মোদী যদি ভুল বলে থাকেন, তা হলে ঠিকটা কী? বারবার প্রশ্ন করেও জবাব মেলেনি। উল্টে দৃশ্যতই উত্তেজিত হয়ে পড়েন অমিতবাবুরা।

নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মোদীকে নজিরবিহীন ভাষায় আক্রমণ করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, মোদী তো সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে বারবার আপনাকে আক্রমণ করছেন। আপনার ছবি বিক্রি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, “এক জন চোর কী বলল, তার উত্তর দিতে হবে? আমি জনগণের কথার উত্তর দেব। আর এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমার দলের পাঁচ হাজার নেতা রয়েছে!” তিনি জানতে চান, মুকুলবাবু, অমিতবাবুরা সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলেননি? তার পরে বলেন, “আমি নিজে কী, আমি জানি না? আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই! আমার কোনও শংসাপত্রের দরকার নেই!” মমতার পাল্টা হুঁশিয়ারি, “আমিও অনেক কিছুই জানি। এখন বলব না। পরে বলব! হাঁড়ি খুলে দিলে একটা ভাতও আর হাঁড়িতে থাকবে না!”

ছবি বিক্রির টাকা প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতাদের এই উত্তেজিত পাল্টা আক্রমণ আরও উৎসাহিতই করেছে বিরোধী শিবিরকে। দিল্লিতে দলের সদর দফতরে বিজেপি-র মুখপাত্র নির্মলা সীতারামন বলেন, “বাংলায় মোদীর জনপ্রিয়তায় মমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। তাই ভয় পেয়ে এমন লজ্জাজনক আক্রমণ করছেন! বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি না করে মমতা

বরং তাঁর তোলা বিষয়গুলির জবাব দিন!” আসরে নেমেছে সিপিএম-ও। আজ, মঙ্গলবার এ নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করতে পারেন বলে জানিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব।

বস্তুত, গৌতমবাবুই প্রথম মমতার আঁকা ছবি বিপুল দামে বিক্রির প্রসঙ্গ তুলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। মোদী যেমন মমতার ছবির ক্রেতার নাম করেননি, তেমনই নাম করেননি গৌতমবাবুও। কিন্তু তিনি অভিযোগ তোলার সময়ই নানা মহল থেকে গুঞ্জন উঠেছিল যে, মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি বিপুল দামে যিনি কিনেছিলেন, তিনি সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। সারদা কেলেঙ্কারি ঘিরে যখন রাজ্য জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে, তখন নতুন করে ছবি প্রসঙ্গ ওঠায় দৃশ্যতই অস্বস্তিতে তৃণমূল নেতৃত্ব।

সবিস্তার...

আর এ দিন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের মন্তব্য তাদের স্বস্তি দেওয়ার বদলে অস্বস্তিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সোমবার শ্যামল সেন কমিশনে হাজিরা দিয়ে বেরোনোর পথে সুদীপ্তকে মমতার ছবি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “না, আমি টাকা দিয়ে কোনও ছবি কিনিনি।” কিন্তু সারদা-কর্তার এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করার উপায় নেই শাসক দলের। উল্টে, এক দিকে সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী কটাক্ষ করে বলেছেন, “তৃণমূল এখন সুদীপ্ত সেনের শংসাপত্র নিয়ে টিকে থাকতে চাইছে! সবাই বুঝে গিয়েছে, এরা জোড়া অপরাধী!” অন্য দিকে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রতারণার অভিযোগে যিনি হাজতে আছেন, তাঁর কথার কী মূল্য আছে? উনি কি বলবেন, আমি ছবি কিনেছি!”

শাসক দলের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে এ দিনই ঘাটাল মহকুমা আদালতে সারদা সম্পর্কিত একটি মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষ বলেছেন, “আমি সারদার বেতনভুক কর্মী ছিলাম মাত্র। সারদার বহু টাকা একটি রাজনৈতিক দল ভোগ করেছে। আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে অনেকেই এখন অনেক কিছু করছে!” বিশ্বপতি বিশ্বাস নামে এক প্রাক্তন তৃণমূল, অধুনা কংগ্রেস নেতা এ দিনই দাবি করেছেন, মোদীও ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় ছবি বিক্রির যে কথা বলেছেন, তা ঠিক। সেই ছবি বিক্রির হয়েছিল ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, মোদী মমতার আঁকা ছবির কথা বলতে গেলেন কেন? বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, হোমওয়ার্ক করেই ময়দানে নেমেছিলেন মোদী। পুরনো তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজেই জানিয়েছিলেন, এর আগে ২০০৪, ২০০৭ ও ২০১১ সালে তিন বার তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। শেষ বার ২০১৩-র জানুয়ারিতে। তার মধ্যে ২০১১-র প্রদর্শনীতে ছবি বিক্রির আয় থেকে ১ কোটি টাকা তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন। ২০০৪-এর প্রদর্শনীর টাকা দেওয়া হয়েছিল স্প্যাস্টিক সোসাইটিতে। ২০০৭-এর ছবি বিক্রির আয় থেকে ১৭ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল নন্দীগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে। তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ভাবে যত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তৃণমূল নেত্রী, ততই তাঁর ছবির দামও বেড়েছে। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছেন মোদী।

এর পরে প্রশ্ন হতে পারে, রাজনীতির সঙ্গে এই ছবি আঁকার যোগ এল কী ভাবে? উত্তরের জন্য পিছিয়ে যেতে হবে সেই ২০১১ সালেই। বিধানসভা নির্বাচনের সময় তৃণমূল প্রার্থীদের দেদার খরচের কথা বলতে গিয়ে কুপন কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনেছিলেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব। সেই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রীই জানিয়েছিলেন, কোনও অস্বচ্ছ পথে তাঁদের যেতে হয় না। তাঁর ছবি বিক্রি করেই নির্বাচনী তহবিলের টাকা তোলেন তিনি। তার আরও বেশ কিছু দিন পরে মমতার ছবির প্রসঙ্গ টেনে গৌতমবাবু প্রশ্ন তোলেন, “উনি কি পিকাসো না মাইকেল এঞ্জেলো, যে ওঁর ছবি লোকে এত টাকা দিয়ে কিনবে?” পাল্টা হিসেবে তৃণমূল নেতৃত্ব যত বার গৌতমবাবুকে তীব্র আক্রমণ করেছেন, তত বারই তিনি বলেছেন, ছবি কারা, কত টাকায় কিনেছেন এই তালিকাটা দিয়ে দিলেই তাঁদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।

রবিবার মোদী সেই একই প্রশ্ন তোলার পরেও তার উত্তর মুকুলবাবুরা দেননি। বরং মোদীকে ‘অহঙ্কারী, উদ্ধত, দাম্ভিক’ বলে আখ্যা দিয়ে মুকুলবাবু বলেছেন, “সমস্ত রাজনৈতিক শালীনতা হারিয়ে উনি বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেলেন! মোদী রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মাত্রা ছাড়িয়েছেন!” অমিতবাবুও দাবি করেছেন, “খুব নিচু স্তরের ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন মোদী।” যা নিয়ে রাহুলবাবুর প্রশ্ন, “মোদী ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন কোথায়? উনি প্রকাশ্যে কিছু প্রশ্ন করেছেন। তার কোনও জবাব নেই! বরং, ওঁরাই মোদীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন!”

প্রশ্ন উঠেছে, ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় কেনা না হলে কত টাকায় ছবি বিক্রি হয়েছে? কিছুটা উত্তেজিত হয়েই মুকুলবাবু জবাব দিয়েছেন, “সব কিছুর হিসেব আছে। চেকে দাম মেটানো হয়েছে।’’ কারা কিনেছে এবং কত টাকায় কেনা হয়েছে? গলার স্বর চড়িয়ে মুকুলবাবু বলেন, “এটা আপনার কাজ নয়! অডিটের কাজ। আপনাদের (সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক) সংস্থা সারদার কাছ থেকে কত টাকার বিজ্ঞাপন পেয়েছে, সেটা আপনি বলবেন?’’ উত্তেজিত অমিতবাবু বলেন, “বারবার অন্যায় প্রশ্ন করা হচ্ছে! আপনার বাড়ির হিসেব কি এই টেবিলে এনে ফেলবেন?”

যা শুনে বিজেপি রাজ্য সভাপতির মন্তব্য, “মূল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া আর সব কিছুই করেছেন ওঁরা!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sarada modi mamata tmc picture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE