জলপাইগুড়িতে বেশ কিছু রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করবে পূর্ত দফতর। সেই কাজের অনুমতি নিতে উত্তরবঙ্গের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে ছুটে আসতে হত কলকাতায়। কিংবা দুর্গাপুরে কোনও প্রকল্পের টেন্ডার ডাকতে হবে। সেই প্রক্রিয়া অনুমোদনের জন্যও দেড়শো কিলোমিটার পথ উজিয়ে মহাকরণে আসতে হত পূর্ত দফতরের অফিসারদের। কারণ একটাই। যিনি ওই অনুমতি দেবেন, সেই চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অফিস কলকাতায়। মান্ধাতা আমলের ওই ‘নিয়ম’কে কার্যত ভেঙেচুরে নতুন রূপ দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডে গত ৪ মার্চ দফতরের নয়া গঠন সংক্রান্ত যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন, সেখানে এই বিষয়টাই গুরুত্ব পেয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ত দফতরের পরিকাঠামো একই রকম রয়ে গিয়েছে। কাজের পরিধি বাড়লেও দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি। ওই প্রাচীন নিয়মবিধির ফাঁসে এক দিকে যেমন কাজের গতি শ্লথ হয়েছে, তেমনই প্রকল্প দেখভালের ক্ষেত্রে পদস্থ কর্তারা বিবিধ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। মূলত এ সব বাধা ডিঙোতেই পূর্ত দফতরকে ঢেলে সাজা হল বলে জানিয়েছেন নবান্নের এক কর্তা। ওই কর্তার কথায়, “কাজে গতি আনতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই রাজ্যের আর্থিক ক্ষেত্রে নানা সংস্কার এনেছেন। ই-স্ট্যাম্পিং, ই-রেজিস্ট্রেশন এবং কর জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সরল করে হাতেনাতে ফল পেয়েছে অর্থ দফতর। এ বার পূর্ত দফতরের কাজেও সংস্কার আনতে চলেছে রাজ্য প্রশাসন।”
কী সেই সংস্কার? বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গোটা রাজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করে প্রতিটি জোনে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের নতুন অফিস তৈরি করবে পূর্ত দফতর। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং (জিটিএ এলাকা বাদে), উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহকে নিয়ে তৈরি উত্তর জোনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বসবেন জলপাইগুড়িতে। বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি ও দুই মেদিনীপুর পশ্চিম জোনে এবং কলকাতা, হাওড়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং দুই ২৪ পরগনা পড়ছে দক্ষিণ জোনে। ওই দুই জোনের সদর অফিস হবে যথাক্রমে দুর্গাপুর ও কলকাতায়। পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, “নয়া পরিকাঠামোয় অফিসারদের আর সব ক্ষেত্রে নবান্নে ছুটে আসতে হবে না। জোনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ারেরাই তাঁদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে পারবেন।” সেই কাজ সামাল দিতে নয়া চিফ ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। পদাধিকার বলে তাঁদের টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান করার কথাও বলা হয়েছে পূর্তসচিবের বিজ্ঞপ্তিতে।
সংস্কারের পথে হেঁটে ক’দিন আগেই ঠিকাদারদের চাকে ঢিল ছুড়েছে রাজ্য প্রশাসন। ওই দফতরের এক কর্তা জানান, কোন কোন ঠিকাদার সরকারি কাজে বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন, তার একটা তালিকা ছিল পূর্ত দফতরে। দফতরের নানা কাজে এত দিন তাঁদেরই একাংশের মৌরসিপাট্টা ছিল মহাকরণে। কিন্তু নতুন সরকার আসার পরে ওই ঠিকাদারদের একচেটিয়া প্রভাব ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে পূর্ত দফতর। ওই পূর্ত-কর্তা বলেন, “আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, সরকারি তালিকাভূক্ত ঠিকাদারদের অনেকেই কাজ করার অবস্থায় নেই। তাঁদের বয়স হয়ে গিয়েছে, সেই আর্থিক সামর্থ্যও নেই। এমনও দেখা গিয়েছে, বেশ ক’জন ঠিকাদার সরকারি কাজের বরাত পেয়েছে অন্যের লাইসেন্স নিয়ে।”
নবান্নের কর্তার মতে, সেই মৌরসিপাট্টা ভাঙতেই বছর দেড়েক আগে ই-টেন্ডারিং চালু করে পূর্ত দফতর। এতে কিছুটা সুফল মিললেও কিছু ঠিকাদারের ‘ষড়যন্ত্র’ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। তিনি বলেন, “গুটি কয়েক ঠিকাদার অন্যদের টেন্ডারে অংশ নিতে বাধা দিতেন। এর ফলে বেশ কিছু প্রকল্পের জন্য একাধিক বার দরপত্র ডাকতে হয়েছিল পূর্ত দফতরকে।” এর পরে ওই সমস্যা মেটাতে নতুন করে টেন্ডার-বিধি জারি করে অর্থ দফতর। তাতে বলা হয়, প্রথম বার ন্যূনতম তিন জনকে টেন্ডারে অংশ নিতে হবে। তা না পাওয়া গেলে দ্বিতীয় বার ডাকতে হবে। সেখানে যদি এক জনও অংশ নেন, তা হলে তাঁকেই কাজের বরাত দিতে হবে। সরকারি নিয়মে ওই শিথিলতা আনার পরে আরও খানিকটা সুফল পায় পূর্ত দফতর।
কিন্তু তখন থেকেই সরকারি নথিভূক্ত ঠিকাদারদের কালো তালিকা করার চেষ্টা চলতে থাকে, জানাচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা। শেষমেষ সেটাই করে দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy