সব ভাল যার শেষ ভাল। দেড় মাস ধরে রোদে পুড়ে প্রাণপাতের পরে এখন সমাপ্তি-পর্বটুকু উতরে দেওয়ার পালা। রাজ্য জুড়ে ভোট-প্রচারের মেজাজে ‘সাবধানের মার নেই’ ভাবটাই এখন প্রকট।
৭ মে চতুর্থ দফার ভোটের জন্য শনিবারের পরে প্রচারের জন্য হাতে গোটা দিন বলতে শুধু আজ, রবিবার। আর ১২ মে, অর্থাৎ শেষ দফার জন্য গোটা একটা সপ্তাহও হাতে নেই। এই স্লগ ওভারে নানা প্রার্থীর নানা ভাবনা।
বহরমপুরের হেভিওয়েট প্রার্থী কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী যেমন বলছেন, “আমার এখন রিল্যাক্স করার সময় নেই। নিজের কেন্দ্রে প্রচার তো এই পয়লা মে থেকে শুরু করলাম।” রেজিনগরে ঘুরতে ঘুরতে তিনি বললেন, “মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক পুরনো। সর্বত্র যদি শেষবেলায় যেতে না-ও পারি, ওঁরা বুঝবেন অবস্থাটা।” অধীরের প্রতিদ্বন্দ্বী, ইন্দ্রনীল সেনও শেষবেলায় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে চলায় জোর দিচ্ছেন।
জয় নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়েও কোনও ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষপাতী নন শাসক দলের দাপুটে নেতা শুভেন্দু অধিকারী। শেষবেলায় তাঁর স্ট্র্যাটেজি একসঙ্গে অনেক লোককে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানে দৌড়। বাজারে জনসভা, জনবহুল এলাকায় রোড-শো ইত্যাদিতে জোর দেওয়া। কয়েক দিনের মধ্যে ময়নায় বড় রোড-শো, নন্দকুমারে চিত্রতারকাদের নিয়ে সভা করার পরিকল্পনা রয়েছে। অক্লান্ত শুভেন্দু বলছেন, “গত বার সিপিএমের বিরুদ্ধে রাগে লোকে ভোট দিয়েছিল। এ বার ইতিবাচক ভোটে জিততে চাইছি।”
ব্যারাকপুরের সিপিএম প্রার্থী সুভাষিণী আলির ভোটপ্রচার নিয়ে এ সব স্লগ ওভার-টোভারের মতো ক্রিকেটীয় শব্দ পছন্দ নয়। রোড শো জাতীয় পরিভাষাও না-পসন্দ। প্রবীণ সুভাষিণী প্রধানত হেঁটেই কেন্দ্র কভার করার ধনুকভাঙা পণ রেখেছেন। হালিশহর, কাঁচারাপাড়া গটগটিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলেন, ৭৫ শতাংশ এলাকা ঘোরা হয়ে গিয়েছে। চেষ্টা করছি, বাকিটাও ঘুরে ফেলতে।
ঘুরছেন দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপি-র তথাগত রায়ও। তাঁরও লক্ষ্য, কেন্দ্রের ‘কভার’ না-হওয়া এলাকাগুলো চিহ্নিত করে প্রচার। তবে বানতলার আঁতিপাতি ঘোরার সময়ে এ দিন দুপুরে তাঁর ঠোঁটে মুচকি হাসি! আস্তিনের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা তাস এখনও জনসমক্ষে ফেলেননি!
সে আবার কী? তথাগতবাবুর সঙ্গে কথার সূত্র ধরে বিরিয়ানি রান্নার উপমা উঠে আসে! বিরিয়ানি দমে তো চড়েছে অনেক ক্ষণ। চাল, মাংস পাকানোর প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জাফরানের মাপে ঘটতে পারে গোলযোগ। ভুলচুক হলে এত দিনের সব পরিশ্রম পণ্ড। শনি-দুপুর অবধি জিপে ঘোরাঘুরির পরে তথাগত বললেন, “কী করছি, পুরোটা ভাঙতে পারছি না। তবে বাবুর্চির হাতে জলের ছিটের মতো কিছু তুকতাক আমার আছে। এখন সেটাই জরুরি।”
উত্তর কলকাতায় রূপা বাগচীও শেষ মুহূর্তের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সিরিয়াস! দেখতে হচ্ছে, কারও অভিমান-টান যেন না থাকে। ভোটাররা সকলেই তো প্রার্থীকে একবার দেখতে চায়। এ দিন বড়বাজার এলাকা, অফিসপাড়া, চাঁদনি চক, বউবাজার ধর্মতলা ঘুরেছেন। শেষ পর্বে রূপার কৌশল, বাড়ি-বাড়ি মিটিং করা বা হেঁটে বস্তি-অভিযান। সবেধন নীলমণি রবিবার থেকে শুরু করে প্রতিটা দিনই গুরুত্বপূর্ণ।
বিজেপি-র বাবুল সুপ্রিয়ের কথায় এই শেষপর্বের কৌশল বা তুকতাকের একটা ব্যাখ্যা মিলল। ‘ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কস’। যেখানে যা ফাঁক আছে, সেটুকু ভরিয়ে ফেলা। পরীক্ষার আগে শেষ রাতের পড়ার মতো। বাবুল জুতোর সুকতলা ক্ষইয়ে বিশাল কেন্দ্রের বারো আনাই চষে ফেলেছেন। এ দিন আসানসোল নর্থের ১০-১২টি গ্রামে চক্কর কেটে চলে গেলেন দুর্গাপুরে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করতে। আসানসোলে রাত পোহালে মোদীর সভার প্রস্তুতির খেয়ালও তিনিই রাখছেন।
যে প্রার্থীদের হাতে এখনও একটু বেশি সময়, তাঁদের টেনশনের পারদও খানিকটা চড়া সুরে বাঁধা। দমদমের বিজেপি প্রার্থী তপন শিকদারের ঝুলিতে ভোট-অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। তিনিও বললেন, “প্রাণপণ পরিশ্রম করছি, দলের লিফলেট সব ভোটারের হাতে তুলে দিতে হবে!” বারাসতে তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদারও দশ হাতে খাটছেন। তাঁর কথায়, “এখন স্ট্র্যাটেজি একটাই, সবার কাছে পৌঁছনো!”
স্লগ ওভারের মেজাজ দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস প্রার্থী মালা রায়ের হাবভাবেও। যদুবাবুর বাজার, এলগিন রোডে ঘুরতে ঘুরতে মালা বলছিলেন, “শুধু কি একটা দিক! সংগঠন, পোলিং এজেন্টদের দিকগুলোও দেখতে হচ্ছে!”
শেষবেলায় এই ঝোড়ো ব্যাটিং কি তবে চড়া ‘আস্কিং রেট’ তাড়া করে দৌড়? যাদবপুরের বাম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী তা মানলেন না। সন্ধ্যায় বারুইপুরের দোসায় পদযাত্রার ফাঁকে সুজন বললেন, “সারা বছর মানুষের সুখদুঃখে সঙ্গে থাকলে এই আস্কিং রেটের তত্ত্ব খাটে না। তবে ভোট লুঠ ঠেকাতে সংগঠন কোথায়, কতটা মজবুত সেটা এখন দেখছি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy