রাতভর শিশিরে ভিজে ভোরের দিকে কোনওক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। কিন্তু টলোমলো পায়ে দু’পা হাঁটার পরেই পড়ে গিয়েছিল।
বুধবার, সারাটা দিন শিলিগুড়ি ‘শাসন’ করার পরে ঘুমপাড়ানি গুলিতে হাতিটিকে কাবু করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সুকনার বনে। জনা তিনেক বনকর্মী বৃহস্পতিবার নজরদারিও চালিয়েছেন নাগাড়ে। তাঁরাই জানিয়েছেন, এ দিন বিকেলের দিকে, মহানন্দার ঘন জঙ্গলে খুব ধীর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে এক সময়ে বনের ঢালে গড়িয়ে গিয়েছিল হাতিটি। তার পর, আর খোঁজ মেলেনি তার। অন্ধকারে তার হদিস করাও সম্ভব ছিল না। অরণ্যের চেনা ঠিকানায় ফিরেও কি বেঁচে রইল হাতিটা?
উত্তর মেলেনি। বনকর্তারা বলছেন, ‘‘মহানন্দার গভীর বনে রাতে তার পিছু নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ভোর থেকে ফের হাতিটির উপরে শুরু হবে নজরদারি।’’ তবে, হস্তী বিশেষজ্ঞ টি এস রাজন মনে করছেন, ‘‘সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ হাতিরা নিশাচর। রোদ এড়াতে দিনে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিলেও, রাতে এক জায়গায় থাকে না।’’ কিন্তু, এ দিন সন্ধ্যায় তার ঘোর আচ্ছন্নতা আর হাঁটা চলার ধরন ‘ভাল ঠেকেনি’ হাতি-বিশেষজ্ঞদের। বন দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ঘুম পাড়ানি গুলির অতিরিক্ত ‘ডোজ’ শীরে বয়ে বেড়ানো হাতিটি বাঁচবে কিনা তা নিয়েই সংশয় রয়ে গিয়েছে।’’
বুধবার ভোরে, ডাবগ্রামের জঙ্গল থেকে বেরোতেই তাকে ঘিরে ধরেছিল জনতা। তাঁদের উৎসাহের আতিশয্যেই এক সময়ে বনে ফেরার পথ ভুলে সে ঢুকে পড়েছিল শিলিগুড়ি শহরে। প্রায় ঘণ্টা চারেক ধরে জনতা তার পিছু নেওয়ায় হুলা পার্টি এনেও হাতিটিকে বনে ফেরাতে পারেননি বনকর্মীরা। বাধ্য হয়ে ছুড়তে হয়েছিল ঘুম পাড়ানি গুলি। বন দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, জনতার ভিড় ঠেলে সামনে এসে গুলি ছোড়াও এক সময়ে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তড়িঘড়িতে হিসেব রাখতে না পেরে, তাই ১০ মিলিমিটারের জায়গায় প্রায় ২৩ মিলিমিটার জাইলাজিল ডার্ট ছোড়া হয়েছিল হাতিটির দিকে। ‘ডোজের’ হেরফের হওয়ায় আচ্ছন্নতা তাই কাটছে না হাতিটির।
ঘুম পাড়ানি গুলিতে একাধিক হাতিকে বশে আনার অভিজ্ঞতা রয়েছে দফতরের প্রাক্তন রেঞ্জ অফিসার কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি বলছেন, ‘‘আসলে ডার্ট ছোড়ার আদর্শ সময় যখন হাতিটি এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন। এ ক্ষেত্রে সেই সুযোগই ছিল না। জনতা হাতিটিকে প্রায় তাড়া করে মারছিল।’’ বাধ্য হয়ে ওই ছুটন্ত হাতিকে ঘুম পাড়ানি গুলি ছুড়তে গিয়েই ‘ডোজ’-এর হেরফের হয়েছে।
তবে, বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বনকর্মীদের প্রশংসা করছেন। জানাচ্ছেন, লোকালয়ে বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়লে ‘কী করণীয়’ তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে অনুষ্ঠানও করবেন তাঁরা। বনকর্মীদের সংগঠন, ‘ওয়েস্টবেঙ্গল সাবর্ডিনেট ফরেস্ট সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক অমল সিংহ এ কাজে বনকর্মীদের সাফল্যই দেখছেন। তিনি মনে করেন, ‘‘ওই কর্মীদের উৎসাহ দিতে পুরস্কার দেওয়া উচিত।’’
শিলিগুড়ির পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘ন্যাফ’-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “কিছু মানুষের উৎসাহের খেসারত দিল হাতিটি। না হলে এমন হত না।” কোচবিহারের পরিবেশ প্রেমী সংস্থা ন্যাস গ্রুপের সম্পাদক অরুপ গুহ ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘লোকালয়ে বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়ার ঘটনার তো বিরাম নেই। তবে, মনে রাখতে হবে, বন দফতর তো ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দা। সাড়ে চার বছর হল সরকার কর্মী নিয়োগ করছেন না। বন পাহারা দেবে কে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy