Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিয়রে বিজেপি, মাখড়া-কাণ্ডে পুলিশ ধরছে শাসক দলকেও

তৃণমূল ১৪, বিজেপি ৩! শুক্রবার পর্যন্ত মাখড়া-কাণ্ডে গ্রেফতারের স্কোর লাইন এটাই। এ দিনই যে ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, তাদের মধ্যে পাঁচ জনই শাসক দলের। (ধৃতদের মধ্যে শেখ আসরাফুল নামে দুবরাজপুর থানার এক ভিলেজ পুলিশও রয়েছেন।) অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূমে এহেন উলটপুরাণে বিস্মিত অনেকেই। পরিস্থিতি এমনই যে নেতাদের মুখের উপর প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

তৃণমূল ১৪, বিজেপি ৩!

শুক্রবার পর্যন্ত মাখড়া-কাণ্ডে গ্রেফতারের স্কোর লাইন এটাই। এ দিনই যে ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, তাদের মধ্যে পাঁচ জনই শাসক দলের। (ধৃতদের মধ্যে শেখ আসরাফুল নামে দুবরাজপুর থানার এক ভিলেজ পুলিশও রয়েছেন।) অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূমে এহেন উলটপুরাণে বিস্মিত অনেকেই।

পরিস্থিতি এমনই যে নেতাদের মুখের উপর প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। শুক্রবারই এমন অভিজ্ঞতা হল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। জেলার একাধিক দলীয় নেতা তাঁর সামনে অভিযোগ করলেন, তৃণমূলের লোকেদের একতরফা ধরা হচ্ছে। শুক্রবার যাঁদের ধরা হয়েছে, তাঁদের নাম এফআইআর-এ পর্যন্ত নেই। তাঁদের আরও বক্তব্য, পুলিশ মিথ্যা কথা বলে দলের লোকেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাঁদের হেফাজতে চাইছে। তৃণমূলের শাসনে এটা মানা সম্ভব নয়। নেতা-কর্মীরা যখন এ সব কথা বলছেন, তখন বোলপুর সার্কিট হাউসে মুকুলবাবুর সঙ্গে ছিলেন অনুব্রতও। ক্ষোভের সামনে পড়ে মুকুলবাবু ওই নেতা-কর্মীদের আশ্বাস দিয়েছেন, সাধারণ ও নির্দোষরা যেন শাস্তি না পান, সেটা তিনি দেখবেন।

কিন্তু যে বীরভূমে পুলিশকে ‘বোম মারা’র কথা বলেও বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারেন তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, যে বীরভূমে থানায় চড়াও হয়ে পুলিশকে মারধর করেও পার পেয়ে যান অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ সুদীপ্ত ঘোষ, সেখানে এমন ঘটছে কী করে! তা-ও সেই পাড়ুইয়ে, যেখানে গত ক’বছর ধরেই অনুব্রতর একচ্ছত্র আধিপত্য।

রাজনীতিকরা বলছেন, এই ঘটনা আসলে বিজেপির ক্রম উত্থানের প্রতিফলন। শাসক দলের লাগামছাড়া দাপটের মুখে গোটা বিরোধী শিবিরই এখন কার্যত বিজেপি-তে নাম লিখিয়েছে। তার পর গেরুয়া পতাকার তলায় একজোট হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। ক্রমে মুঠো আলগা হয়েছে তৃণমূলের। ফলে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার জন্য চাপ বেড়েছে পুলিশের উপরে।

মাখড়াই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। একদা তৃণমূলের ঘাঁটি এই গ্রামটি লোকসভা ভোটের পরে ধীরে ধীরে বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে। মাখড়া ফিরে দখল করতে গিয়ে বহিরাগতদের নিয়ে তৃণমূল হামলা চালিয়েছিল বলেই অভিযোগ। যার জেরে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। কিন্তু তার পরেও গ্রাম শাসক দলের দখলে আসেনি। বিজেপির প্রতিরোধে পিছু হঠেছে তৃণমূল।

জেলার এক মাঝারি মাপের পুলিশকর্মীর কথায়, “বিশেষ করে বোলপুর মহকুমার (যা অনুব্রতর খাসতালুক হিসাবে পরিচিত) অনেক এলাকায় রাশ আলগা হচ্ছে তৃণমূলের। পাড়ুই, ইলামবাজারের একাধিক গ্রামের মানুষ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। লোকসভা ভোটের আগেও যাঁদের তৃণমূলের মিছিলে দেখেছি, তাঁরাই বিজেপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ফলে মাখড়ার ঘটনায় অভিযুক্ত শাসক দলের লোকেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চাপ থাকছেই।”

গত লোকসভা নির্বাচন থেকে রাজ্যে শক্তি বাড়ছে বিজেপির। সেই ভোটে দু’টি আসন জয়ের পরে বিধানসভা উপনির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে জয় পেয়েছে তারা। অনেকেই বলছেন, বাম এবং কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে রাজ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দল হয়ে ওঠার পথে তারা দ্রুত এগিয়ে আসছে। মাখড়াতেও তৃণমূলের সঙ্গে তাদেরই সংঘর্ষ হয়েছে। পরে পরিস্থিতি দেখতে চৌমণ্ডলপুরে গিয়ে বৃহস্পতিবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মুখতার আব্বাস নকভি, কীর্তি আজাদের মতো একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। সেই গ্রেফতারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ-অবরোধে নেমে পড়েন বিজেপি সমর্থকরা। শুক্রবারও তৃণমূল ও পুলিশের ‘সন্ত্রাস’-এর প্রতিবাদে হাওড়া সেতু অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। আচমকা অবরোধে কলকাতা ও হাওড়ামুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যানজট ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায়। ৩টে নাগাদ পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কয়েক জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ ভ্যান ও বাসে তুলে গোলাবাড়ি থানায় নিয়ে চলে গেলে অবরোধ ওঠে। শুক্রবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যপালকে অভিযোগ জানাতে রাজভবনে যান রাহুল সিংহ-সহ দলের রাজ্য নেতারা।

এর উপরে যোগ হয়েছে বিজেপির বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের হুঁশিয়ারি। এ দিন সিউড়িতে জেলাশাসকের কার্যালয়ের পাশে ধর্নামঞ্চ থেকে পুলিশ সুপারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এক শ্রেণির পুলিশকর্মী আছেন, যাঁরা মিথ্যা মামলায় বিজেপি নেতা-কর্মীদের ফাঁসাচ্ছেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিজেপি-র অন্য চেহারা দেখবেন! আমাদের ধৈর্যের বাঁধ কিন্তু ভাঙছে!” পুলিশের একাংশ মনে করছে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়েই সম্ভবত এ রকম কথা বলেছেন দুধকুমার।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন অনুব্রতর দাপটে চুপ থাকার পরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে জেলার নিচুতলার পুলিশও। বস্তুত, অনুব্রতর প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি, সুদীপ্তর থানায় চড়াও হয়ে পুলিশকে মারধরের পরেও তাঁদের গ্রেফতার করতে না-পারায় নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মনোবল তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সেখানে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি তাদের সাহস জুগিয়েছে। রাজনীতির রং না-দেখে ধরপাকড়ের পিছনে সেটাও বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, শুধু বিজেপি নয়, ব্যবস্থা নিতে চাপ আছে শাসক দলের দিক থেকেও। বীরভূমে পরের পর ঘটনায় যে ভাবে তৃণমূল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তা মাখড়া-কাণ্ডের পরে আরও বেড়েছে। বিশেষ করে হামলার দিন পুলিশের হাত গুটিয়ে বসে থাকা এবং বিভিন্ন মহল থেকে তার তুমুল সমালোচনা সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়েছে। তাই পুলিশকে কিছুটা ‘তৎপর’ হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “নবান্ন থেকেও পুলিশের কাছে এ রকমই একটা বার্তা এসেছে।” বোলপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ অবশ্য বলেন, “পুলিশ নিজের কাজ করছে। এই নিয়ে কিছু বলব না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

makhra case TMC bjp parui
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE