Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সইল না ৪ নেতা, মন্ত্রীর ৪ ঘণ্টার রগড়ানি

সোমবার ভরদুপুর। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বাইরে তখন প্রবল উত্তেজনা। কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলারদের নেতৃত্ব শতাধিক দলীয় কর্মী-সমর্থক প্রায় ‘দেখে নেব’ মনোভাব নিয়ে অবস্থানে বসেছেন।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

সোমবার ভরদুপুর। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বাইরে তখন প্রবল উত্তেজনা। কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলারদের নেতৃত্ব শতাধিক দলীয় কর্মী-সমর্থক প্রায় ‘দেখে নেব’ মনোভাব নিয়ে অবস্থানে বসেছেন। ভিতরে, নির্বাচন কমিশনারের ঘরে তাঁর টেবিলের উল্টো দিকে শাসক দলের চার শীর্ষ নেতা। দাবি, আড়াইখানা পুরসভার ভোট স্থগিতের যে ঘোষণা সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় করেছেন, তা প্রত্যাহার করে পূর্বনির্ধারিত ৭ অক্টোবর, অর্থাৎ বুধবারেই করতে হবে। সুশান্তবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সীর হাতে চার ঘণ্টা কার্যত অবরুদ্ধ হয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার। নেতা-মন্ত্রীদের চাপ ক্রমশ হুমকিতে পরিণত হয়।

এবং তার জেরেই শেষ পর্যন্ত হার মানেন সুশান্তবাবু। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ যে নির্বাচন কমিশনার দাপট দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘গণনা ৭ অক্টোবর হবে না। অন্তত ১০০টা ক্যামেরার ছবি খতিয়ে দেখতে হবে,’ সেই তিনিই সন্ধ্যা ৭টায় মচকে গিয়ে জানিয়ে দেন, ৯ অক্টোবর গণনা হবে। সুশান্তবাবুর ঘনিষ্ঠদের দাবি, হার মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর কোনও উপায় ছিল না। নেতা-মন্ত্রীদের হাতে ঘেরাও হয়েও গোড়ায় নিজের অবস্থানেই তিনি অনড় ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে চলে যায়। শাসক দলের নেতামন্ত্রীদের কাছে যে ভাবে অপমানিত হতে হয়েছে সুশান্তবাবুকে, গোটা কর্মজীবনে আর কখনও হয়নি বলেই দাবি তাঁর ঘনিষ্ঠদের। তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, ভুটানে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী এক মন্ত্রীর কাছ থেকে বার বার ফোন আসছিল অবরোধে থাকা এক মন্ত্রীর কাছে। কমিশনারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তিনি কী করছেন, তা থিম্পু থেকেও নজরে রাখা হচ্ছে। ফলে আরও অপমানিত হওয়ার আগেই ভোট গণনার নতুন দিন ঘোষণা করে ঘেরাও মুক্ত হন সুশান্তবাবু।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

কিন্তু কতটা চাপের ছিল ওই চার ঘণ্টার বৈঠক?

কমিশনারের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, এক বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা সুশান্তবাবুকে বলেন, ‘‘এর আগে কোনও ডব্লিউবিসিএস অফিসার এই পদে বসেননি। আর আপনি আমাদেরই বিরুদ্ধাচরণ করছেন!’’ রাজ্যের এক মন্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘‘আপনাকে এখনই গণনার দিন জানাতে হবে। না হলে বেরতে দেব না, ঘেরাও করে রাখব।’’

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মঙ্গলবার এক মন্ত্রী কমিশনারকে চাপ দেওয়া বা অপমান করার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘‘আমরা প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলাম। কমিশনের কাছে জমা পড়া বিধাননগরের সব বুথের প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি এবং পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট আমাদের হাতে ছিল। আমরা জানতাম, সেই রিপোর্টে একটি মাত্র বুথে গোলমালের কথা বলা হয়েছে।’’ ওই মন্ত্রী জানান, কোনও প্রিসাইডিং অফিসারই বহিরাগতদের উপস্থিতি, বুথ দখল বা গণ্ডগোলের কথা উল্লেখ করেননি। পর্যবেক্ষকেরাও মোটের উপর একই রিপোর্ট দিয়েছেন। ফলে কমিশনারকে চেপে ধরতে সুবিধা হয়েছিল।

কেমন সেই চেপে ধরা?

আর এক মন্ত্রী জানান, কমিশনারের কাছে গণনা স্থগিতের কারণ জানতে চাওয়া হয়। তাঁর জবাব ছিল, কমিশন বুথে যে সব ক্যামেরা বসিয়েছিল, তাতে বিস্তর গোলমাল ধরা পড়েছে। অনেক বুথে ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০০টি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখার জন্যই গণনা স্থগিত করতে হয়েছে। ভোটের দিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গোলমালের যে খবর দেখানো হয়েছিল, সে কথারও উল্লেখ করেন কমিশনার। এটা শুনেই শাসক দলের প্রতিনিধিরা তাঁকে চেপে ধরেন। দলের এক বর্ষীয়ান নেতা তাঁকে বলেন, ‘‘আমাদের টাকা থাকলে দেখিয়ে দিতাম, পরের দিন সব কাগজই ভোটের প্রশংসা করে খবর লিখেছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বা উত্তরপ্রদেশে যা সম্ভব, এখানে তা হয় না। আর আপনি কী ভাবে সংবাদমাধ্যমের খবরের উপরে ভিত্তি করে গণনা স্থগিত রাখলেন।’’ কমিশনারের কাছে তিনি জানতে চান, ‘‘ক্যামেরার উপরে ভরসা করে পুনর্নির্বাচন করতে হবে — এটা কোন আইনে বলা আছে?’’

কমিশনারকে তাঁরা প্রশ্ন করেন, প্রিসাইডিং অফিসারদের ডায়েরিতে কোথাও গরমিলের কথা বলা হয়েছে কি? কোনও পর্যবেক্ষক রিপোর্ট দিয়ে পুনর্নির্বাচন চেয়েছেন? কোথাও ১০০% ভোট পড়েছে? কোনও বুথে অন্য রাজনৈতিক দলের এজেন্ট ছিল না, এমন লিখিত অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছে? যদি এ সব না হয়ে থাকে, তা হলে সুশান্তবাবু ভোটগণনা স্থগিত করলেন কেন?

কমিশনারের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, নেতা-মন্ত্রীদের প্রশ্ন প্রায় হুমকির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। সুশান্তবাবু তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, সব রিপোর্ট এবং ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব কিছু দেখেই প্রয়োজন মতো পুনর্নির্বাচন করা হবে। গণনা হবে তার পরে। তখন এক নেতা ফের হুমকির সুরে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনারের অফিসটাকে দেখছি থানা স্তরে নামিয়ে এনেছেন। থানার ওসি যেমন সবার সঙ্গে কথা বলেন, ডেপুটেশন নেন, আপনিও তাই করছেন। এ সব চলবে না। যদি গণনা স্থগিতই করার ছিল, তা হলে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে করলেন না কেন? কেন বিজেপি-র চাপে নতিস্বীকার করলেন?’’

কমিশনার বলেন, তিনি কোনও চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি। তাঁর পাশে বসে থাকা কমিশনের এক অফিসারও সুশান্তবাবুর সাংবিধানিক ক্ষমতার কথা তৃণমূল নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেন। তা শুনে আরও উত্তেজিত হয়ে এক নেতা বলেন, সাংবিধানিক পদের গরিমা কমিশনার রাখতে পারছেন না। সেই কারণেই কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা কমিশনের সিদ্ধান্ত আগাম ঘোষণা করে দিতে পারছেন। যা থেকে স্পষ্ট, রাজনৈতিক দলের কথাতেই তিনি চলছেন। কিন্তু এ সব চলবে না। ভোট গণনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতেই হবে। না হলে ঘেরাও করে রাখা হবে।

কমিশনারকে জানানো হয়, ১১ অক্টোবর প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট এবং ১২ তারিখ মহালয়া। ফলে ১০ অক্টোবরের পরে আর পুলিশ দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রশাসন কোনও সহযোগিতা করতে পারবে না। যা করার তার আগেই করতে হবে। চার ঘণ্টা ধরে দুই মন্ত্রী-মেয়র-সাংসদের চাপের মুখে সুশান্তবাবু দু’ঘণ্টা সময় চেয়ে নেন। নেতারাও তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে অবস্থান মঞ্চে চলে আসেন।

কমিশনের এক কর্তা এ দিন জানান, ভোটে কারচুপি নিয়ে কমিশনের হাতে অস্ত্র ছিল ক্যামেরার ফুটেজ, ভোট চলাকালীন বেশ কয়েক জন প্রিসাইডিং অফিসারের এসএমএস এবং কয়েক জন সেক্টর অফিসার, পোলিং অফিসারের টেলিফোনের ভয়েস রেকর্ড। কিন্তু ভোট চলাকালীন যাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁরাই আবার লিখিত রিপোর্টে ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোটের জানিয়েছেন। আবার কমিশনে পৌঁছনোর আগেই সে সব চলে গিয়েছে শাসক দলের হাতে। ফলে কমিশনারও কিছুটা চাপে পড়ে যান। তিনি প্রাথমিক ভাবে সাংবাদিকদের জানান, কোনও ভাবেই ৭ অক্টোবর ভোট গণনা করা যাবে না। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন।

কমিশনারকে চাপে ফেলার প্রসঙ্গ তুলতেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলবার বলেন, ‘‘আমরা কোনও চাপ দিইনি। উনি যে বিরোধীদের চাপে প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি, পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টও উপেক্ষা করে ভোট গণনা স্থগিত করে দিয়েছিলেন, সেটাই বুঝিয়েছি। ওঁকে চাপমুক্ত হতে সাহায্য করেছি।’’ চাপ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সাংসদ সুব্রত বক্সীও। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘নির্বাচন কমিশন যাতে নিয়মকানুন মেনে ভোট করে, তা আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কমিশনারকে চাপ দিয়ে সিদ্ধান্ত বদলের প্রশ্নই ওঠে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE