Advertisement
১১ মে ২০২৪
অভিযোগকারী সিপি নেতা সৌমেনের গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন

সবং মামলার শুনানিতে আরুষি হত্যা প্রসঙ্গ

খুনের ঘটনায় অভিযোগকারীকেই এ বার অভিযুক্ত ঠাওরাল পুলিশ। সবং কলেজে ছাত্র পরিষদ (সিপি) কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে খুনের অভিযোগে এ বার গ্রেফতার করা হল ওই কলেজের সিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়কে।

প্রিজন ভ্যান থেকে নামছেন সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রিজন ভ্যান থেকে নামছেন সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৮
Share: Save:

খুনের ঘটনায় অভিযোগকারীকেই এ বার অভিযুক্ত ঠাওরাল পুলিশ। সবং কলেজে ছাত্র পরিষদ (সিপি) কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে খুনের অভিযোগে এ বার গ্রেফতার করা হল ওই কলেজের সিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৌমেনের অভিযোগের ভিত্তিতে এই মামলাটি শুরু হয়েছিল।

শুক্রবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের পানিপারুল থেকে গ্রেফতার করা হয় সৌমেনকে। শনিবার দুপুরে মেদিনীপুরের ভারপ্রাপ্ত সিজেএম মহম্মদ মহিবুল্লা-র এজলাসে তাঁকে হাজির করে ১০ দিনের জন্য হেফাজতে চায় পুলিশ। কেন অভিযোগকারীকেই গ্রেফতার করা হল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শনিবার আদালতে আরুষি হত্যা মামলার প্রসঙ্গ টেনে আনেন সরকারপক্ষের আইনজীবী দীপক সাহা। তাঁর কথায়, “আরুষি হত্যায় যে তাঁর বাবা-মা জড়িত, এটা কি আগে কেউ ভেবেছিলেন। পরে দেখা যায়, বাবা- মা’ই ওই হত্যায় জড়িত।’’ তিনি আরও জানান, সবং মামলায় নেওয়া গোপন জবানবন্দিতেই সৌমেনের নাম পাওয়া গিয়েছে। পুলিশের দাবি, সৌমেনকে আগেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি আসেননি। মেদিনীপুর সিজেএম আদালত তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সেই পরোয়ানাই কার্যকর করা হয়েছে।

অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী চন্দন গুহ জামিনের আবেদন করে বলেন, “সৌমেন অভিযোগকারী। অথচ, পুলিশ তাঁকেই গ্রেফতার করল। আসলে পুলিশ অন্য পথে তদন্ত করতে চাইছে। রাজ্যের প্রশাসক (মুখ্যমন্ত্রী) বলে দিয়েছেন, এটা একটা গোষ্ঠীর গোলমাল। জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা (পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ) ওই বক্তব্যকে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’’ দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে ভারপ্রাপ্ত সিজেএম ধৃতকে ৩ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এই নিয়ে সবং হত্যা মামলায় ধৃতের সংখ্যা হল ৬। এরমধ্যে ৩ জন টিএমসিপি- র। ৩ জন সিপি-র।

সৌমেন গ্রেফতারের পরে নতুন করে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছে কংগ্রেস ও সিপি নেতৃত্ব। সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “বাড়ির বাইরে থাকায় সৌমেন পুলিশের নোটিস পায়নি। তাতে পুলিশ সুপার খেপে গিয়ে সৌমেনকে গ্রেফতার করেছেন। আসলে মুখ্যমন্ত্রীর কথা মেনে তার কন্যা ভারতী ঘোষ ছাত্র পরিষদকে ও কংগ্রেসকে ধ্বংস করে সবংকে মরুভূমিতে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।’’ সিপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি মহম্মদ সইফুলেরও বক্তব্য, “যিনি অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেন, কৃষ্ণপ্রসাদকে চিকিত্‌সার জন্য হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, শ্মশানে গিয়ে চোখের জল ফেললেন, পুলিশ তাঁকেই গ্রেফতার করল। আসলে মুখ্যমন্ত্রীর দেখানো পথেই পুলিশকে চলতে হচ্ছে।’’ সবংয়ের তৃণমূলের নেতা অমূল্য মাইতি যদিও বলেন, “নিজের দোষ জেনেই ও (সৌমেন) পালাচ্ছিল। পুলিশ তাই প্রমাণ-সহ ওকে গ্রেফতার করেছে। কংগ্রেস কলেজের সামনে অবস্থানে বসলে আমরাও প্রতিবাদে তেমাথানিতে অবস্থানে বসব।’’

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সৌমেনকে আগেই তলব করেছিল পুলিশ। মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানায় তিনি যাননি। পরে সিপি-র দাবি মতো সবং থানায় ডেকে পাঠানোর পরে সেখানেও যাননি তিনি। এলাকাতেও ছিলেন না। গত ৭ অগস্ট সবং কলেজে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পরেই ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেনই প্রথম কলেজ অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগপত্র অধ্যক্ষ কানাইলাল পড়িয়া পাঠিয়ে দেন সবং থানায়। তার ভিত্তিতেই খুনের মামলা রুজু করে পুলিশ। সেখানে অভিযুক্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) ছ’জনের মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। যদিও ঘটনার পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ওই ঘটনাটি ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীকোন্দলের জের। পরে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষও সাংবাদিক বৈঠক ডেকে জানিয়ে দেন, অভিযুক্তদের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়নি। ঘটনাটি ছাত্র পরিষদের কোন্দলের জের বলে পরে দাবি করেন ভারতীদেবীও। পল্টু ওঝা এবং সুদীপ পাত্র সিপি-র দুই কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়। পাশাপাশি সিপি-র বেশ কয়েক জন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দফায় দফায় তলব করে পুলিশ।

সৌমেন ছাড়াও সিপি-র সবং কলেজ শাখার সভাপতি শ্যামল ওঝা-সহ ১৫ জনকে নোটিস দিয়ে গত ২৪ অগস্ট মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল। তাতে সাড়া না দিয়ে সবং থানায় জিজ্ঞাসাবাদের আর্জি জানিয়ে তদন্তকারী অফিসার বিশ্বজিৎ মণ্ডলকে আবেদন করেন ওই ছাত্ররা। পরে যদিও দু’জন মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানায় যান এবং তখনই সুদীপকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সৌমেন, শ্যামল-সহ ১৪ জনকে ২৭ অগস্ট সবং থানাতেই তলব করে পুলিশ। তারপরেও কেউই যাননি। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, যে ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের নামে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাতে ওই সিপি কর্মীরা আতঙ্কিত। শুক্রবার সবংয়ে কংগ্রেস আয়োজিত কৃষ্ণপ্রসাদের স্মরণসভাতেও ছিলেন না সৌমেন।

এ দিকে, সৌমেনের খোঁজ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। শুক্রবার তেমাথানির সভায় কংগ্রেস নেতারা অভিযোগ করেন, সৌমেনের মামা সুশান্ত ভট্টাচার্যকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে। এ দিন সৌমেনের বাবা বিমল গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন, “ছেলের খোঁজে আমার শ্যালককে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাতে আমার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সৌমেন বাইরে গিয়েছিল। সব জেনে ও নিজেই পানিপারুলে চলে আসে। বাধ্য হয়েই পুলিশের কাছে ধরা দেয় সৌমেন।’’ ব্লক কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক আবু কালাম বক্সেরও দাবি, “পরিজনেরা পুলিশি হয়রানির মধ্যে পড়ছে শুনে সৌমেন আত্মসমর্পণ করেছেন।’’

পুলিশ সূত্রে খবর, নোটিস পাওয়ার পর থেকেই সৌমেন পলাতক ছিলেন। তিনি ওড়িশায় আত্মীয়বাড়িতে রয়েছেন বলে অনুমান করেছিল পুলিশ। পরে মামা সুশান্তবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সৌমেনের একটি মোবাইলের নম্বর পায় পুলিশ। শুক্রবার সকালেই সৌমেনের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এরপর রাতে মোবাইল টাওয়ারের সূত্র ধরে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় পানিপারুল বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী প্রতীক্ষালয় থেকে সৌমেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ এ দিন ফোন ধরেননি। তবে পুলিশ সূত্রের খবর, সংঘর্ষের সময় কলেজের সিসিটিভি ফুটেজে সৌমেনকে দেখা গিয়েছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন লোককে জেরা করে খুনের ঘটনায় সৌমেন যুক্ত রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। তার উপর নোটিস পাঠিয়ে ডাকার পরে থানায় না আসায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় সৌমেনের নামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE