Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার খালবিল শুকনো, ভরসা সেই দক্ষিণী মাছ

সিজানোয় দেশি মাছের আকাল

সিজানো উৎসবের বাজার। কিন্তু বাজারে দেশি মাছের নামই নেই। হা হুতাশ করা গৃহস্থের মুখরক্ষা করল অগত্যা সেই দক্ষিণী মাছই। শনিবার সরস্বতী পুজোর দিনে থলে হাতে বাজারে ঢুকে দেশি মাছের জন্য কোণায় কোণায় ঘুরে চারামাছের বেশি দেশি মাছের মুখ দেখা যায়নি।

মাছের দাম নিয়ে দরাদরি। পুরুলিয়ার বড়হাটে শনিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

মাছের দাম নিয়ে দরাদরি। পুরুলিয়ার বড়হাটে শনিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২০
Share: Save:

সিজানো উৎসবের বাজার। কিন্তু বাজারে দেশি মাছের নামই নেই। হা হুতাশ করা গৃহস্থের মুখরক্ষা করল অগত্যা সেই দক্ষিণী মাছই।

শনিবার সরস্বতী পুজোর দিনে থলে হাতে বাজারে ঢুকে দেশি মাছের জন্য কোণায় কোণায় ঘুরে চারামাছের বেশি দেশি মাছের মুখ দেখা যায়নি। কেউ কেউ কয়েকটা বড় দেশি মাছ পেলেও তার দাম শুনে চমকে উঠেছেন। ভিড়ের মধ্যে সেই মাছই অন্য কেউ মোটা টাকায় দাঁও মেরে কার্যত ছিনিয়ে নিয়ে লটারি জেতার মতো আহ্লাদে বাড়িমুখো হয়েছেন।

পুরুলিয়ার বড়হাট থেকে ঝালদা, আদ্রা, রঘুনাথপুর, কাশীপুর, বলরামপুর, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, খাতড়া— সবর্ত্রই বাজারের এই একই ছবি দেখা গিয়েছে। বাকিদের আক্ষেপ করতে দেখে মাছ বিক্রেতারা আক্ষেপ করে জানান, বৃষ্টিই নেই। খালবিল থেকে পুকুর সব খাঁ খাঁ। মাছ আর থাকবে কোথায়?

পুরুলিয়ার লোক গবেষক সুভাষ রায় জানান, সরস্বতী পুজোর পরের দিনে সন্তানের মঙ্গল কামনায় রাঢ়বঙ্গ জুড়ে অরন্ধন ষষ্ঠী পালন করা হয়। পুজোর দিনে ভাত ও পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে রাখা হয়। পরের দিন সেই পান্তাভাত খেতে হয়। এ রীতি বহুকালের। মাছ-ভাতের বাঙালির এই উৎসবে মাছই প্রধান অঙ্গ। তাই সরস্বতী পুজোর দিনে যাঁর যেমনই রোজগার, মাছ তিনি সাধ্যমতো কেনেন। ফলে অন্য দিনের তুলনায় সিজানো উৎসবে মাছের জোগান প্রচণ্ড বেড়ে যায়।

যেমন পুরুলিয়া বড়হাটের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী সাধন ধীবর জানালেন, সাধারণ দিনে পুরুলিয়ার বাজারে মাছের চাহিদা থাকে ১৩০ পেটি (প্রতি ৪০ কেজিতে এক পেটি)। আর সিজানোর জন্য মাছের চাহিদা পৌঁছে যায় প্রায় ১২০০ পেটি। মাছের আর এক আড়তদার আবদুল জব্বার বলেন, ‘‘আমার কাছে সাধারণ দিনে পাঁচ পেটি মানে মাছের চাহিদা থাকে। আর এ দিন ৫০ পেটি-র কমে নয়।’’

সিজানোয় ক্রেতাদের দেশি মাছের চাহিদা বরাবর থাকে। এ বারও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় দেশি মাছের জোগান এ বারে বেশ কম। পুরুলিয়ার বড়হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী দেবদাস ধীবরের কথায়, ‘‘এ বারে দেশি মাছ সেভাবে আসেনি। আর এলেও দাম ছিল চড়া। এক কুইন্টাল দেশি এসেছে তো ছয় টন চালানি।’’ একই অভিজ্ঞতা বাঁকুড়া বাজারের ব্যবসায়ী পন্ডা ধীবর, কাশীপুর বাজারের খুচরো ব্যবসায়ী আঘনি কৈবর্তেরও।

তবে অতিকায় মাছ নিয়ে এ দিনও বাজারে-বাজারে কৌতূহল বেশ ছিল। এ দিন আদ্রা বাজারে ৩২ কেজির একটি মাছ দেখতে অনেকে ভিড় করেছিলেন। সেই মাছ ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

গতবার থেকেই জেলা পরিষদ এ দিনের জন্য কিছুটা কম দামে মাছ বিক্রি শুরু করেছে। বলরামপুরের কুমারী কাননে সিএডিসি-র (সুসংহত এলাকা উন্নয়ন নিগম) পুকুর এবং মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি থেকে মাছ সংগ্রহ করে এ দিন পুরুলিয়া, বরাবাজার, মানবাজার, নিতুড়িয়া প্রভৃতি বাজারে জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৮০০ গ্রাম থেকে ২ কেজি ওজনের মাছ ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় খুবই নগন্য। সেখানে স্থানীয় বাজারে ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের দেশি মাছের দাম ছিল ১২০-১৫০ টাকা প্রতি কেজিতে। আড়াই কেজি থেকে চার কেজি ওজনের দেশি কাতলা মাছের দাম ছিল ৩০০ টাকা প্রতি কেজি।

দেশি মাছ নিয়ে বাজারের হাহাকার পৌঁছে গিয়েছে গৃহস্থের হেঁশেলেও। ঝালদার পুরপ্রধান মধুসূদন কয়ালের স্ত্রী বিমলা কয়ালের আক্ষেপ, ‘‘সিজানো তো মাছের পরব। দেশি মাছ কেনা হলেও যেমনটা প্রতিবার পাওয়া যায়, এ বার তেমন ভাল দেশি মাছ পেলাম না।’’

জেলা পরিষদের দেওয়া মাছ কম দামে পেয়ে খুশিতে ডগমগ মানবাজারের নামোপাড়ার বাসিন্দা অনাথবন্ধু মুখোপাধ্যায়। তিনি মানবাজারের কিসান মান্ডি থেকে ১০০ টাকা দরে মাছ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরেন।

তবে অনেক ক্রেতার সস্তায় মাছ কেনার সৌভাগ্য হয়নি। মাইতি পাড়ার বাসিন্দা সনাতন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাড়ে ৯টার মধ্যে মাছ শেষ। মাছই পেলাম না।’’ তাঁদের জন্য জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর আশ্বাস, আগামী দিনে জেলার সব এলাকার ক্রেতাদের সস্তায় মাছ দেওয়ার জন্য আরও মাছ আনার চেষ্টা করা হবে।

মাছের পরব এলেই নানা স্মৃতি ভিড় করে অতীত ফেলে আসা মানুষজনের। তাঁদের কাছে অতীত মানেই সোনালি দিন। পঞ্চকোট রাজ পরিবারের সদস্য প্রশান্ত কিশোর লাল সিংহ দেওয়ের কথায়, ‘‘তখন পুকুরে ভোর রাতে জাল ফেলা হতো। কত মাছ উঠত। এলাকার মানুষকে সিজানো উৎসবের সময় বিলিয়ে দেওয়া হতো। আর জেলেদের মধ্যে কে কত বড় মাছ পেল তাই নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। আর এখন দেশি মাছ মিলছে না!’’

কৃষ্ণনগর থেকে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের সূত্রে পুরুলিয়ায় আসা উদয়ন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এই মাছের পরবে আমাদের বাড়িতে সারা গ্রামের লোক এসে ভাত, মাছ, তরকারি নিয়ে যেত। সেটাই ছিল প্রসাদ। সে সবই এখন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE