Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
অশনি সঙ্কেত /২

হারানো টিয়ার দল কি আবার ফিরছে গ্রামে

আদিবাসীদের যাবতীয় ‘অভিমান-অনুযোগের’ মধ্যেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। তাঁর কথায় ‘‘লালগড় আন্দোলন থিতিয়ে যেতেই দলের একাংশের কাছে আদিবাসীদের গুরুত্ব ফুরিয়ে গিয়েছে। আদিবাসীদের হাতের-পাঁচ ভেবে নেওয়াটা যে বড় ভুল— তার আভাস কিন্তু জঙ্গলমহল টের পেতে শুরু করেছে।’’ বাঁশপাহাড়ির কদকুড়া, শিমুলপাল এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে মাওবাদীরা যে এই ‘অপ্রাপ্তি’র কথাটা ফের পাখি-পড়া করে বোঝানো শুরু করেছে, মেনে নিচ্ছেন শাসক দলের ওই নেতা।

রাহুল রায়
বাঁশপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

আদিবাসীদের যাবতীয় ‘অভিমান-অনুযোগের’ মধ্যেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। তাঁর কথায় ‘‘লালগড় আন্দোলন থিতিয়ে যেতেই দলের একাংশের কাছে আদিবাসীদের গুরুত্ব ফুরিয়ে গিয়েছে। আদিবাসীদের হাতের-পাঁচ ভেবে নেওয়াটা যে বড় ভুল— তার আভাস কিন্তু জঙ্গলমহল টের পেতে শুরু করেছে।’’ বাঁশপাহাড়ির কদকুড়া, শিমুলপাল এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে মাওবাদীরা যে এই ‘অপ্রাপ্তি’র কথাটা ফের পাখি-পড়া করে বোঝানো শুরু করেছে, মেনে নিচ্ছেন শাসক দলের ওই নেতা।

মাওবাদীরা তৃণমূলের আদিবাসী নেতৃত্বের মধ্যেও ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে বলেও জানাচ্ছেন তিনি।

পাঁচ বছর আগেও বিজয় সিংলহরের পরিচতি ছিল মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য হিসেবে। রাজ্যে পালাবদলের পরে সরকারের ‘ভরসা’ পেয়ে আত্মসমর্পণ করে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। রাতারাতি অঞ্চল কমিটির সদস্যপদও জুটে গিয়েছিল তাঁর।

বাঁকুড়ার বারিকুল ব্লকের সিংলহর গ্রামের বিজয়কে ‘প্রাপ্তিযোগের’ টাটকা নমুনা হিসেবে তুলে ধরেছিল শাসক দলও। হাতেনাতে ফল মিলতে শুরু করেছিল। তবে মধুচন্দ্রিমা-পর্ব ফিকে হয়ে আসার মাঝেই, বছর খানেক আগে গরুখুটান উৎসবের সন্ধ্যায় খুন হয়ে গিয়েছিলেন বিজয়। আর তাতেই সামনে এসে পড়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে আদিবাসীদের সম্পর্কের দূরত্বটা। বারিকুল এলাকার তৃণমূলের এক আদিবাসী নেতা, যিনি নিজেও একদা ‘বনপার্টি’র সমর্থক ছিলেন, বলছেন— ‘‘গ্রেফতার এড়াতে যে সব আদিবাসীরা সে দিন শাসক দলে যোগ দিয়ে আশ্রয় খুঁজেছিলেন, তাঁদের এ ভাবেই একে একে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।’’ যা শুনে বারিকুল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের অনিমা হাঁসদা যদিও বলছেন, ‘‘এ সব বানানো কথা।’’ উন্নয়নের ‘জুয়ার’ (জোয়ার) আসার স্বপ্ন দেখছেন তিনিও। কী সেই উন্নয়ন? জতরদা গ্রামের রাস্তায় অপা মাহাতো খুঁজে দিচ্ছেন— শুকনো নালার উপরে নীল-সাদা ডোরা কাটা সদ্য তৈরি কজওয়ে আর গ্রামের প্রবেশ পথে গ্লোসাইনে লেখা গ্রামের নাম। আর? অপা বলছেন, ‘‘বাকিটো সরকারের আশ্বাস— হবেক, হবেক। কবে হবেক কেউ জানে না।’’

দক্ষিণ বাঁকুড়ার সিপিএমের এক নেতা বলছেন, ‘‘গত সাড়ে চার বছর ধরে আদিবাসীদের সামনে ২১ দফা প্রতিশ্রুতির গাজর ঝুলিয়ে রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল, যার একটিও মেলেনি। জেলা দফতর থেকে তৃণমূলের নেতারা এখন তাই জঙ্গলমহলে পা রাখতেই সাহস পাচ্ছেন না।’’

তবে, টিলা-জঙ্গলের আড়ালে জঙ্গলমহলের আদিবাসী বসতে মাওবাদীদের পা যে নতুন করে পড়ছে, তা মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য। তিনি সতর্ক করছেন, ‘‘আদিবাসীদের মধ্যে তৃণমূলের কোণঠাসা অবস্থাটা দেখে আমাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও এখন মজা পাচ্ছেন। তবে কী জানেন, আদিবাসীদের এই চাপা অসন্তোষটা যদি আমাদের বদলে মাওবাদীরা কাজে লাগিয়ে ফেলে, তা হলে কিন্তু নেতা-কর্মীরা মজাটা ভাল করেই বুঝবেন!’’ আদিবাসীদের মধ্যে সরকার-বিরোধিতার প্রচারের খবর তাঁর কাছে এসেছে বলে জানাচ্ছেন বাঁকুড়ার সিপিএম নেতা অমিয় পাত্রও। আর বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘বারিকুল থানার অদূরে গত ৬ এবং ১৩ অগস্ট বৈঠক করে গিয়েছে মাওবাদীরা। আদিবাসী সমাজের বেশ কয়েক জন মাতব্বরকে সেই বৈঠকে ডেকে বোঝানো হয়েছে, শাসক দলের জুলুমবাজি আর ফাঁকা আশ্বাসের কথা।’’ লালগড় আন্দোলনের ঝাঁঝালো দিনে ধোজুড়ি গ্রামের ঘরে ঘরে খোঁজ মিলত পুষ্যি-টিয়ার। অচেনা মুখের পুলিশি চরের আনাগোনা টের পেলেই টিয়া ডেকে উঠত— ‘বাং চিনাত হড়’, যা-র অর্থ ‘অচেনা লোক’। যা শুনে বাড়ির পুরুষেরা গা-ঢাকা দিতেন লাগোয়া বাবুই ঘাসের জঙ্গলে। গ্রামের লক্ষ্মণ সর্দার বলছেন, ‘‘যৌথ বাহিনী গ্রামের দখল নেওয়ার পরে জঙ্গলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল টিয়াগুলো।’’

জঙ্গলমহলের হাওয়ায় ঘুরছে প্রশ্নটা— ধোজুড়ির হারানো টিয়ারা কি আবার গ্রামে ফিরছে?

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE