Advertisement
০১ মে ২০২৪

ভোট দিয়ে, না দিয়েও প্রতিবাদ সল্টলেকে

কেউ পাশের বাড়ির ছেলেটাকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেয়েছেন। বুথ অবধি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কেউ বা সকাল ৮টা থেকে ১০টা উদভ্রান্তের মতো দৌড়াদৌড়ি করেছেন, আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ভোটাধিকার প্রয়োগের।

 ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসছেন অন্নপূর্ণা সরকার।

ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসছেন অন্নপূর্ণা সরকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

কেউ পাশের বাড়ির ছেলেটাকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেয়েছেন। বুথ অবধি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কেউ বা সকাল ৮টা থেকে ১০টা উদভ্রান্তের মতো দৌড়াদৌড়ি করেছেন, আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ভোটাধিকার প্রয়োগের। শেষ পর্যন্ত না পেরে ফিরে গিয়েছেন। কেউ বা বহিরাগত কিছু ছেলের হিংস্র চেহারা দেখে ভয় পেয়েছেন। ভোট না-দিয়েই বাড়ি ফিরেছেন। গত শনিবার, ৩ অক্টোবরের ভোটের পরে কারও ছেলে আবার রহস্যজনক ভাবে মারা গিয়েছেন। দেহ মিলেছে রেললাইনে। শুক্রবার তাঁরা সকলেই প্রতিবাদ জানালেন নিজের নিজের মতো করে। কেউ ভোট দিয়ে। এবং বেশির ভাগই, ভোট না-দিয়ে।

সল্টলেকের কে সি ব্লকের বাসিন্দা উদয় মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী এ দিন বুথমুখো হননি। গত শনিবারের ভোটে সিপিএমের পোলিং এজেন্ট হয়েছিলেন তাঁদের ছেলে উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। অভিযোগ, বুথে তাঁকে মারধর করেছিল বহিরাগতরা, পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। রবিবার রাতে ওই পোলিং এজেন্টের দেহ মেলে উল্টোডাঙা স্টেশনের কাছে। ছেলের হত্যার এর বিচার চেয়ে শুক্রবার ভোট দিলেন না উদয়বাবুরা। ভোট দিতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে মার খেয়েছিলেন বৃদ্ধা গীতা মহাপাত্র। প্রতিবাদে এ দিন বুথে আসেননি ।

ঠিক উল্টো পথেও প্রতিবাদ জানালেন অনেকে। এ দিন ভোটকেন্দ্রের বাইরে পুলিশের ভিড় দেখে সাহস করে বুথে এসেছেন তাঁরা। নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। বলে গিয়েছেন, সে দিন প্রতিবাদ করতে পারেননি। সেই ক্ষমতাও ছিল না। এ দিন ভোট দিয়ে সেই প্রতিবাদ নথিভুক্ত করে গেলেন। অনেকের আবার প্রতিবাদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে। তাঁদের বক্তব্য, যে বুথে গণ্ডগোলই হয়নি সেখানেও কেন পুনর্নির্বাচন!

সকাল সওয়া সাতটাতেই সল্টলেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রূপা গৌতম। বললেন, ‘‘সে দিন ৮টা থেকে ১০টা উদভ্রান্তের মতো দৌড়েছি। আমার মেসোমশাইকে ভোট দিতে দিল না। নামের পাশে ‘মেরো’ লেখা ছিল। বলল, ভোট নেই। আর আমাদের তো ঢুকতেই দিল না। কয়েকটা ষন্ডা মার্কা ছেলে বলে দিল, ৩০ বছর অনেক ভোট দিয়েছিস। আর দিতে হবে না।’’ ভোট দিয়ে বেরিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত দেখাল ওই মহিলাকে। বললেন, ‘‘সে দিন এত নিরাপত্তা থাকলে তো সমস্যাই ছিল না। নির্ভয়ে ভোট দিতে পারতাম। আজ একটা প্রতিবাদ করতে পারলাম বলে মনে হচ্ছে।’’

এবি ব্লকের সোমা বসু বা অধীরানন্দরাও এসেছিলেন বহিরাগত তাণ্ডবের ‘জবাব’ দিতে। অধীরানন্দের কথায়, ‘‘শনিবার ছিল ফিয়ার ভোট। আজ ফেয়ার ভোট দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে গেলাম।’’

শনিবার সকাল থেকে টেলিভিশনে এবি ব্লকের কমিউনিটি হলের বাইরে বহিরাগতদের হাতে প্রীতিকুমার সেনকে বেধড়ক মার খেতে দেখেছিল সারা রাজ্য। সে দিনও ভোট দিয়েছিলেন। এ দিন ফের এলেন নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে। বললেন, ‘‘শনিবার এমন ভোটই তো দেখতে চেয়েছিলাম।’’ বছর সত্তরের অনুতা মুখোপাধ্যায় নিগৃহীতা হয়েছিলেন বহিরাগতদের হাতে। পাড়ারই এক ছেলেকে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে। তার পরেও অবশ্য ভোট দিয়েছিলেন। এ দিনও দিলেন। বলে গেলেন, ‘‘সে দিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম। আবার ভোট নেওয়া হলে ফের আসব প্রতিবাদ জানাতে।’’ সে দিন বোমা পড়ার মধ্যেই ভোট দিয়েছিলেন অশোককুমার দাশগুপ্ত। এ দিনও দিলেন। বললেন, ‘‘নকশাল আমলে কলেজে পড়েছি। এ সব ছোটখাটো বোমায় ভয় পাই না।’’

অন্য প্রতিবাদ ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের দু’টি বুথে। এখানে অনেকেই ভোট দিলেন কমিশনের ভুল সিদ্ধান্তের ‘জবাব’ দিতে। কেসি ব্লকের সাগরিকা দে বলেন, ‘‘আমরা এখানে শান্তিতেই ভোট দিয়েছিলাম। তবু পুনর্নির্বাচন! এ সিদ্ধান্ত মানতে পারছি না।’’ একই ক্ষোভ পার্থসারথি উপাধ্যায় বা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার বিজনেন্দু ভট্টাচার্যদেরও। সেই প্রতিবাদ জানাতেই এ দিনও ভোট দিয়েছেন তাঁরা।

কিন্তু যাঁরা ভোট দিলেন না, তাঁদের প্রতিবাদ কী নিয়ে?

প্রতিবাদ জানাতে আবার ভোটই দিলেন না গীতাদেবী ও অমলেন্দুবিকাশ মহাপাত্র।

সদ্য পুত্রহারা পরিবার প্রৌঢ় দম্পতি ভোট দেননি বিচার চেয়ে। কেউ সেদিনের ভোট-লুটের প্রতিবাদে। সল্টলেকের বাসিন্দাদের একটি অংশ আবার বুথমুখো হননি অন্য এক প্রশ্ন তুলে। তাঁদের বক্তব্য, ভোটযন্ত্রে ‘নোটা’ বোতাম যোগ করে রাজনীতির ন‌োংরামোকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যবস্থা করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। রাজ্য নির্বাচন কমিশন কেন ভোটযন্ত্রে সে ব্যবস্থা রাখেনি?

গত শনিবার দুষ্কৃতী তাণ্ডবে উত্তাল হয়েছিল যে এলাকা, সেই এফডি ব্লকে ৮২ বছরের ননীগোপাল সাহা বললেন, ‘‘রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ক্ষমতা নেই। এটা আমার নীরব নিন্দা। ভোট না দিয়েই গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলাম।’’ এফডি ব্লকে দু’টি বুথে ফের ভোট নেওয়া হল এ দিন। দু’টি বুথেই ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের নীচে।

প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ২৮টি ভোটে কাজ করেছেন এফডি ব্লকের বাসিন্দা অমলেন্দুবিকাশ মহাপাত্র। ওই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার বলছেন, ‘‘কষ্ট করে কেন আর ভোট দিতে যাব, ভোট দেওয়ার জন্য তো বহিরাগতরা রয়েছে। ওরা তাদের দিয়েই ভোট করাক!’’ ওই ব্লকেরই উজ্জ্বল দত্তের কথায়, ‘‘এটা সল্টলেকের সংস্কৃতি নয়। কোনও দিন এমন দেখিনি। কী হবে ভোট দিয়ে?’’ প্রাক্তন সরকারি অফিসার উজ্জ্বলবাবু কর্মজীবনে ২২টি ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন।

কেউ কেউ আবার বলেছেন, ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করেই বুথে যাননি তাঁরা। যেমন এফডি ব্লকের মনোরঞ্জন অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘আগের দিন গোটা সল্টলেকে দুষ্কৃতী তাণ্ডব হল। আর পুনর্নির্বাচন হবে হাতে

গোনা ক’টি বুথে! এ কি ছেলে ভোলানো খেলা?’’

এফডি ব্লকেরই ৫৯ নম্বরে ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা বাড়ির অলক দাস, অমিতাভ দে, দিলীপ বিশ্বাস, রেখা ভট্টাচার্যরা জানান, সব বুথে পুনর্নির্বাচন না হওয়ার প্রতিবাদেই তাঁরা ভোট বয়কট করেছেন।

ভোট দিতে যাননি এইচবি ব্লকের অনেক বাসিন্দাও। তাঁদেরই এক জন শৈলজা বিয়ানি। ৩ অক্টোবর ভোট দিতে পেরেছিলেন। এ দিন গেলেন না কেন? শৈলজা বলছেন, ‘‘আগের দিন সল্টলেকে যা হল, তাতে নাগরিক অধিকার বলে কিছু বাকি নেই। সবই কি গুন্ডারাজ হয়ে যাচ্ছে?’’

ভোট দেননি কে সি ব্লকের অনেক বাসিন্দাই। এখানেই থাকতেন উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাবা উদয়বাবু নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে বোরেননি এ দিন। ‘‘এজেন্ট হওয়ার সত্ত্বেও ওর নিজের ভোটটাই পড়ে গিয়েছিল। তারই প্রতিবাদ করেছিল। যে ভোটে ছেলে প্রতিবাদ করে, সেখানে আমি বাবা হয়ে কী ভাবে ভোট দিতে যাই?’’ প্রশ্ন করেন সদ্য পুত্রহারা বাবা। কাকে!

— নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE