Advertisement
০৭ মে ২০২৪
ঘুষের ঘরে টাকার বান

দেওয়াল-মেঝে-কমোডে ১২ কোটি

টাকার গদি তো কোন ছার! টাকার সোফা, টাকার মেঝে, টাকার দেওয়াল— বললেও ভুল হয় না। এমনকী, বাথরুমের কমোডের ঢাকনি সরাতেও বেরিয়ে এল টাকার পাহাড়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

টাকার গদি তো কোন ছার! টাকার সোফা, টাকার মেঝে, টাকার দেওয়াল— বললেও ভুল হয় না। এমনকী, বাথরুমের কমোডের ঢাকনি সরাতেও বেরিয়ে এল টাকার পাহাড়।

শুক্রবার দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাওড়ার একটি বাড়ির অন্দরমহলে যা চলল, তা পুরোদস্তুর রোমহর্ষক সিনেমার উপাদান। কখনও দেওয়াল-আলমারি খুলতেই ‘নায়ক’ ছবির স্বপ্নদৃশ্যের মতো তাড়া-তাড়া ৫০০-১০০০ টাকার নোট মাথায় এসে পড়ছে! কখনও বেরিয়ে পড়ছে কয়েক কেজি সোনার গয়না ও সোনার বাট। মালিপাঁচঘরায় তস্য গলির ভিতরে রাজ্য পুলিশের দুর্নীতিদমন শাখার অফিসারেরা তখন নিজেদের গায়ে চিমটি কেটে স্বপ্ন না সত্যি বুঝতে চাইছেন! চিচিং ফাঁক করে গুহায় ঢুকে থরে থরে হিরে-জহরত দেখে আলিবাবার চোখ বুঝি এমনই ধাঁধিয়ে গিয়েছিল!

ঘটনাস্থল, ১৪০ নম্বর নস্করপাড়া লেন। গৃহকর্তা সাবেক বালি পুরসভার (বর্তমানে হাওড়া পুরসভার অন্তর্ভুক্ত) সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারী। পুলিশের দাবি, এ দিন রাত পর্যন্ত তাঁর বাড়ি থেকে কমপক্ষে ১২ কোটি টাকা ও বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না উদ্ধার করা হয়েছে। রাজ্য পুলিশের এডিজি (দুর্নীতিদমন শাখা) রামফল পওয়ারের কথায়, ‘‘গভীর রাত পর্যন্ত প্রণববাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া সব টাকা আমরা গুনে শেষ করতে পারিনি!’’ দুর্নীতি ও আয়বহির্ভূত সম্পত্তি জড়ো করার অভিযোগে এ দিন বিকেলেই প্রণববাবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্রকন্যার সঙ্গেও পুলিশ কথা বলছে।

বাহারি লোহার গ্রিলে ঘেরা গোল বারান্দাওয়ালা দোতলা বাড়িটার সামনে প্রোমোটারদের ভিড় লেগেই থাকত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। ফি-সন্ধেয় বাড়ির নীচে মোটরবাইক আরোহী প্রোমোটারদের দেখা যেত বলে পুলিশকে জানিয়েছেন এলাকার লোকজন। কিন্তু তাই বলে বাড়ির ভিতরে যে আক্ষরিক অর্থেই টাকার আড়ত গড়ে উঠেছে, তা কেউই আঁচ করেননি। দুর্নীতিদমন শাখার এক অফিসার যেমন বলছিলেন, ‘‘বিশ বছর ধরে ঘুষ খেলেও এত টাকা জমানো চাট্টিখানি কথা নয়।’’


এঁর বাড়িতেই টাকার পাহাড়। ধৃত বালি পুরসভার সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারী।

নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই এ দিন প্রণববাবুর বাড়িতে হানা দেয় তদন্তকারী দল। প্রথমটা পুলিশকে দরজা খুলতে চাইছিলেন না পরিবারের লোকজন। পরে দরজা খুলতে বাধ্য হন তাঁরা। গৃহকর্তা তত ক্ষণে পিছনের দরজা দিয়ে সটকে পড়েছিলেন বলেই পুলিশের দাবি। পরে পাড়া-প্রতিবেশীর সাহায্যে প্রণববাবুকে ওই তল্লাট থেকেই পাকড়াও করা হয়। এর পরে শুরু হয় তল্লাশি-অভিযান। মেঝের টাইল্‌স খুলতেই বেরিয়ে পড়ে সার-সার বাক্স। তাতে ঠাসা নোটের তাড়া। এর পরে ক্রমশ সাত-আটের দশকে বলিউডি ভিলেনের আস্তানায় যেমন দেখা যেত, বা হালের ‘স্পেশাল ছাব্বিশ’ ছবির মতো— যেখানেই হাত পড়ে, সেখান থেকেই নোট বেরিয়ে আসতে থাকে। টাকা গুনতে গুনতে পুলিশের গলদঘর্ম দশা!

মোহর মাপার জন্য আলিবাবা বউ ফতিমাকে পাঠিয়েছিল কাসেমের বাড়ি থেকে কুনকে চেয়ে আনার জন্য। হাওড়ার প্রণববাবুর বাড়িতে এ দিন বিকেল নাগাদ টাকা গোনার দু-দু’টি মেশিন আনাতে হল পুলিশকে। আর এল ঢাউস দু’টো ট্রাঙ্ক। পুলিশকর্মীরা গার্ডার ও সুতো দিয়ে নোটের তাড়া বেঁধে ট্রাঙ্কে ভরতে লাগলেন। স্থানীয় বাসিন্দা গণেশ অধিকারী পুলিশের সঙ্গে প্রণববাবুর বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন। তিনি পরে বলেন, ‘‘সোফা কেটে গাদা-গাদা নোট বার করছে পুলিশ, নিজের চোখে দেখলাম।’’ বাথরুমেও টাকা লুকোনোর জন্য একটি আলাদা কমোডের বন্দোবস্ত ছিল। এ দিন গভীর রাত পর্যন্ত সব টাকা গুনে শেষ করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে বার কয়েক কলকাতা বা অন্যত্র টাকা জাল করার সরঞ্জামের হদিস মিলেছে। কিন্তু এত টাকা একসঙ্গে উদ্ধার হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, বালি পুরসভা এলাকার ওই সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার কী করে এই বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হলেন। পুরসভা সূত্রের খবর, লিলুয়া এলাকায় বাড়ি ও রাস্তা তৈরির বাড়ির নকশা অনুমোদনের ছাড়পত্র দেওয়ার দায়িত্ব ছিল প্রণববাবুর উপরে। ১৯৯৫-’৯৬ থেকে তিনি এ দায়িত্বে। এই ক’বছরে অন্তত ১৬০০ কাঠা জমিতে বহুতল নির্মাণের অনুমোদন তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে বলে পুর সূত্রেরই খবর। পুলিশ জেনেছে, প্রোমোটারদের কাছে ওই তল্লাটে কাঠা প্রতি এক লক্ষ টাকা দাবি করা হতো। আর রাস্তা নির্মাণের বেলায় মজুরদের ঠিকাদারকে তাঁর ভাগের ৩০% এই পুর আধিকারিককে দিতে হতো বলে অভিযোগ। ফলে গত দু’-দশকে লিলুয়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো নির্মাণকাজ ও ঘন ঘন রাস্তা সারাইয়ের সঙ্গে প্রণববাবুর সমৃদ্ধির যোগ আছে বলেই মত কারও কারও।

বালি অঞ্চলের ৯০ শতাংশ কারখানাই লিলুয়ায়। সেখানে শপিং মল, সিনেমা হলও এন্তার গজিয়েছে। এই সব নির্মাণের সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ যথেষ্ট পুরনো। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, প্রোমোটারদের সঙ্গে গোলমালের জেরেই এ বার প্রণববাবুর বিষয়ে অভিযোগ পুলিশের কানে পৌঁছয়। এই বিপুল টাকা উদ্ধারের সঙ্গে-সঙ্গে বালি পুরসভায় দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন বাম পুরবোর্ডের ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরচেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ী বা প্রাক্তন চেয়ারম্যান পারিষদ (পূর্ত) প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায় এই সব ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে পুরসভার কোনও সম্পর্ক নেই বলেই দাবি করছেন। তবে প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘উনি (প্রণব) যে ঘুষ নেন, লোকমুখে সে নালিশ শুনেছিলাম।’’ তা হলে তদন্ত করাননি কেন? প্রদীপবাবুর দাবি, লিখিত অভিযোগ কখনও জমা পড়েনি বলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। আর, বালির তৃণমূল নেতা ভাস্করগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এ তো হিমশৈলের চুড়ো! দেখবেন, আরও কত কী ঝুলি থেকে বেরোবে!’’

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE