রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে ঘরে। বৃহস্পতিবার রােত। নিজস্ব চিত্র।
শহরে নিজের বাড়িতেই আইনজীবীর স্ত্রীর অপমৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামীকেই গ্রেফতার করল পুলিশ। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তাঁকে আটক করে জেরা শুরু করেছিল পুলিশ। বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতের বিরুদ্ধে বেআইনি অস্ত্র আইনের জামিন অযোগ্য ২৫, ২৭ ও ৩৫ ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর বাড়ির পিছনের ডোবার পাশে ঝোপ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি নাইনএমএম পিস্তল ও তিন রাউন্ড কার্তুজ দেবাশিসবাবুর বলে জেরায় তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করলেও তিনি তাঁর স্ত্রীকে খুন করেননি বলে দাবি করেছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে রেণুকা বসুকে (৪৩) রক্তাক্ত অবস্থায় রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান স্বামী দেবাশিস-বসু সহ প্রতিবেশীরাই। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিত্সকেরা। শুক্রবার ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, রেণুকাদেবীর মাথার পিছনে একটি গুলি পাওয়া গিয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার অমিতকুমার ভরত রাঠৌর বলেন, ‘‘রেণুকাদেবীকে খুন করা হয়েছে, নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা এখনও বলার মতো সময় আসেনি। তদন্ত হোক তারপরেই সব বলব।’’ রায়গঞ্জ থানার আইসি গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা ময়নাতদন্তের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। সেই রিপোর্ট হাতে পেলে এটি খুন না আত্মহত্যা তা স্পষ্ট হবে। যদি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে এটি খুন বলে প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে নিশ্চই অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে খুনের মামলা দায়ের করা হবে।’’
রায়গঞ্জ জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবী দেবাশিসবাবুর দাবি, শুক্রবার রাতে তিনি মোহনবাটি বাজার গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এক আইনজীবীর বাড়ি হয়ে বাড়িতে ফিরে দেখেন সামনের ঘরের দরজা খোলা। তাঁর স্ত্রী রক্তাক্ত অবস্থায় শোওয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। তাঁর চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রাথমিক তদন্তে দেবাশিসবাবুর বয়ানে একাধিক অসঙ্গতি থাকায় রাতেই তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করে পুলিশ। তাঁকে জেরা করে এ দিন সকালে তাঁর বাড়ির পিছনের একটি ডোবার ধারের ঝোপ থেকে একটি নাইনএমএম পিস্তল ও তিন রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার হয়। পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। রেণুকাদেবী গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ে দেবাশিসবাবু কোথায় ছিলেন তা জানতে তাঁর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
তবে মৃত্যু-রহস্য বাড়িয়েছে একটি সুইসাইড নোট। পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার গভীর রাতে রেণুকাদেবীর শোওয়ার ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়েছে। সেটিতে রেণুকাদেবীর নাম করে দাবি, করা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তবে ওই চিঠিটিতে লেখা বয়ান রেণুকাদেবীর হাতের লেখা কি না তা জানতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। উদ্ধার হওয়া নাইনএমএম পিস্তলটিতে রেণুকাদেবীর হাতের ছাপ রয়েছে কি না তা জানতেও সেটি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে পুলিশ।
তদন্তে নেমে একাধিক প্রশ্নও উঠে এসেছে তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের মধ্যে। প্রথমত, রেণুকাদেবী যদি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, তাহলে গুলির শব্দ প্রতিবেশীরা কেউ শুনতে পেলেন না কেন। দ্বিতীয়ত, বাড়িতে একটি পোষা কুকুর থাকলেও ঘটনার সময়ে সেটি চিত্কার করল না কেন। তৃতীয়ত, রেণুকাদেবী যদি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যাই করে থাকেন, তাহলে তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কে নাইনএমএম পিস্তলটি কী ভাবে বাড়ির পিছনের ডোবার ধারে ঝোপে ফেলল। দেবাশিসবাবুর ছেলে কলকাতায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। মেয়ে ডালখোলার একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়েই থাকতেন দেবাশিসবাবু। এ দিন দুই ছেলেমেয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। দেবাশিসবাবুর প্রতিবেশী পেশায় গ্যারাজকর্মী মহেশ তাঁতির দাবি, ‘‘ঘটনার দিন রাতে দেবাশিসবাবুর বাড়ি কোনও গুলির শব্দ পাইনি। বাড়িতে কেউ আসলে কুকুরটির চিত্কার করা অভ্যাস। তবে ওইদিন সেটিও কোনও চিত্কার করেনি।’’
রেণুকাদেবীর বাবার বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরের বংশীহারি থানার শিওল এলাকায়। বাবা ষষ্ঠীচরণবাবু ৩২ বছর আগে মারা গিয়েছেন। প্রায় সাত বছর আগে মা তরঙ্গিনীদেবী মারা যাওয়ার পর থেকে রেণুকাদেবী বাবার বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এ দিন রেণুকাদেবীর দুই দাদা পেশায় মাছ ব্যবসায়ী শঙ্করবাবু ও হরিচরণবাবু হাসপাতালের পুলিশ মর্গে গিয়ে বোনের মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁরা বলেন, ‘‘আমার বোন খুব নিরীহ প্রকৃতির মেয়ে ছিল। ও আত্মহত্যা করতে পারে বলে ভাবতে পারছি না। জামাইয়ের সঙ্গে ওর কোনও গোলমাল ছিল বলে বোন আমাদের কোনওদিন কিছু জানায়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy