Advertisement
০৪ মে ২০২৪

পোস্ট অফিসে লাইন দিতে রাতদুপুরে রওনা

মাঝরাতে বুকে হঠাৎ প্রবল ব্যথা। স্ট্রোক! বারাসতের রথীন মজুমদারকে তড়িঘড়ি কলকাতার নামী নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছিলেন বাড়ির লোক। খরচের চিন্তা করেননি।

ভোর সওয়া ছ’টা। সল্টলেক সিকে মার্কেট পোস্ট অফিসের সামনে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতীক্ষার পালা। ছবি: সৌভিক দে।

ভোর সওয়া ছ’টা। সল্টলেক সিকে মার্কেট পোস্ট অফিসের সামনে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতীক্ষার পালা। ছবি: সৌভিক দে।

অশোক সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

মাঝরাতে বুকে হঠাৎ প্রবল ব্যথা। স্ট্রোক!

বারাসতের রথীন মজুমদারকে তড়িঘড়ি কলকাতার নামী নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছিলেন বাড়ির লোক। খরচের চিন্তা করেননি। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক অফিসার রথীনবাবুর সঞ্চয় না হোক কম নয়। বেশিটাই পোস্ট অফিসে মজুত। পেনশনের টাকায় সংসার চলে যায়, তাই এমআইএসের টাকায় হাতই পড়ে না। জমতে জমতে ভাল অঙ্ক দাঁড়িয়েছে। তুলতে কত ক্ষণ!

কিন্তু সেই টাকা তুলতে গিয়ে পরিজনদেরই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়! শুনলেন, নতুন নিয়ম হয়েছে। রথীনবাবুর নামে ডাকঘর সেভিংস অ্যাকাউন্ট থাকা চাই। টাকা তাতে জমা পড়বে। সেখান থেকে টাকা তোলা যাবে, নচেৎ নয়।

কোনও মতে ধার-কর্জ করে নার্সিংহোমের বিল মিটিয়ে বাড়ি ফেরার পরে রথীনবাবু প্রায় রোজই পোস্ট অফিসে দৌড়চ্ছেন, সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলার তাগিদে। রোজই হতাশ হয়ে ফিরছেন। কারণ, প্রতি দিনই সেখানে ‘লিঙ্ক ফেলিওর।’ প্রবল গরমে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে দিন-কে–দিন আরও কাহিল হয়ে পড়ছেন মধ্য ষাটের বৃদ্ধ।

ওঁর মতো নাকাল অবস্থা এখন লাখো মানুষের। শুধু কলকাতা বা বারাসতে নয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, তামাম দেশেই বহু ডাকঘরে কার্যত নৈরাজ্য। পোস্ট অফিসে ‘কোর ব্যাঙ্কিং সল্যুশন’ (সিবিএস) চালু হচ্ছে। তাই ঢেলে সাজা হচ্ছে লেনদেনের যাবতীয় পদ্ধতি। নতুন ব্যবস্থায় মাউসের ক্লিকেই সব কাজ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে ‘লিঙ্ক’ উধাও হয়ে কম্পিউটার বসিয়ে দিচ্ছে। পাসবই আপডেট, পেমেন্ট বা নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা— সব শিকেয়। চেক সংক্রান্ত গণ্ডগোলও কম নয়।

সব মিলিয়ে তুঙ্গ দুর্ভোগ। গ্রাহকদের যেমন, কর্মীদেরও তেমন। কাউন্টারের ও-ধারে কর্মীরা অসহায় মুখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকছেন, এ-ধারে থিকথিকে ভিড় মুহুর্মুহু ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। বেশির ভাগ পোস্ট অফিসে প্রচুর বয়স্ক গ্রাহক। পেনশন, এমআইএসের টাকায় তাঁদের দিন গুজরান হয়। সবচেয়ে ভোগান্তি ওঁদেরই। হাওড়ার এক ডাকঘরের সামনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো এক দিন পথ অবরোধই করে বসলেন! আবার গত সপ্তাহে সল্টলেকের এক পোস্ট অফিসে লাইন দেওয়ার জন্য রাত তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। মাঝপথে কুকুরের তাড়া খেয়ে ফিরে আসেন। সেই অভিজ্ঞতার পরে গত ক’দিন ধরে আলো ফুটলে বেরোচ্ছেন। ‘‘তা-ও রোজ গিয়ে দেখি, আমাদের আগে অন্তত আট-দশ জন! আর রোজই লিঙ্ক ফেলিওর। দুপুর পর্যন্ত দেখে ফিরে আসছি। এই গরমে কাঁহাতক পারা যায়!’’— হতাশা ঝরে পড়ে বৃদ্ধের গলায়। মধ্য কলকাতার এক ডাকঘরের জনৈক কর্মচারীর আক্ষেপ, ‘‘বয়স্ক মানুষগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাদেরই খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব, বলুন? আমাদের হাতে তো কিছু নেই!’’

সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন ডাক-কর্তৃপক্ষও। চিফ পোস্ট মাস্টার জেনারেল (সিপিএমজি-বেঙ্গল সার্কেল) অরুন্ধতী ঘোষের বক্তব্য, পোস্ট অফিসে সিবিএস পরিষেবা শুরু করতে গিয়ে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে মূলত প্রযুক্তিগত কিছু কারণ।

কী রকম?

সিপিএমজি বলেন, ‘‘সিবিএসের মূল উদ্দেশ্য— সমস্ত ডাকঘরকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা। তাই লোক্যাল এরিয়া নেটওয়ার্কের (ল্যান) বদলে ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (ওয়ান) ব্যবহার হচ্ছে। তাতেই বিপত্তি। কোথাও রাস্তা খোঁড়ার ফলে নেটওয়ার্ক থাকছে না। কখনও এমন কোনও ঝামেলা হচ্ছে, যার সুরাহা আমাদের আয়ত্তের বাইরে।’’ কিন্তু ব্যাঙ্কেও তো সিবিএস! সেখানে কি এমন হয়েছে?

‘‘এই দু’টো ক্ষেত্রে তুলনা চলে না’’— মন্তব্য সিপিএমজি’র। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘পোস্ট অফিসের কাজকর্মের পরিধি এত বড় ও বহুমুখী যে, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার।’’

সন্দেহ নেই, সিবিএসের সুবিধা বিস্তর। এমনকী, এতে ডাকঘরের গ্রাহকেরা ব্যাঙ্কের মতো এটিএম কার্ড দিয়ে টাকাও তুলতে পারবেন। উদ্যোগের সূত্রপাত ২০১৪-র শেষাশেষি। এই প্রায় দেড় বছরে পশ্চিমবঙ্গের ১৭,০৬৪টি ডাকঘরের মধ্যে ১২১১টিতে সিবিএস চালু করা গিয়েছে। যদিও নেটওয়ার্কের খামখেয়ালিপনায় সেগুলোয় রোজকার কাজ চালানোই এখন দায় বলে অভিযোগ।

সিপিএমজি-র অবশ্য দাবি, কর্তৃপক্ষের তরফে চেষ্টার ত্রুটি নেই। ‘‘হিসেব-নিকেশের জটিলতায় বিশেষত এমআইএসে বড় ব্যাকলগ হয়ে গিয়েছে। বকেয়া কাজ তুলতে বেশ ক’টা দল বানিয়েছি। তারা পুরোদমে নেমে পড়েছে।’’— বলছেন অরুন্ধতীদেবী। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘প্রযুক্তি-পরিকাঠামোয় এ হেন ব্যাপক পরিবর্তনের সার্বিক সুফল গ্রাহকেরাই পাবেন। এতে একটু সময় তো লাগবেই।’’ পুজোর আগে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে তিনি আশাবাদী।

পুজো অনেক দেরি। সে পর্যন্ত কত দূর সামাল দেওয়া যাবে, তা ভেবে গ্রাহকদের সঙ্গে এজেন্টরাও মহা দুশ্চিন্তায়। সন্তোষপুর পোস্ট অফিসের এক এজেন্টের প্রশ্ন, ‘‘১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এখানে সব রকম ডিপোজিট নেওয়া বন্ধ। রোজগারপাতি হবে কী করে?’’ ডাকঘরের এক অফিসারের যুক্তি, ‘‘গোটা অ্যাকাউন্টিং পদ্ধতি বদলানো হচ্ছে। তাই সাময়িক ভাবে কিছু পরিষেবা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।’’ পোস্ট অফিসে টাকা জমা করার ‘হ্যাপা’ দেখে গ্রাম-গঞ্জের লোক আবার ফেরেব্বাজ লগ্নিসংস্থার খপ্পরে গিয়ে পড়বেন, এমন আশঙ্কাও দানা বেঁধেছে প্রশাসনের অন্দরে।

এর উপরে কর্মী বাড়ন্ত। ডাক-সূত্রের খবর: ইসিএস পদ্ধতির দৌলতে ক’মাস আগেও ভিড় সামাল দিতে তেমন অসুবিধে ছিল না। কিন্তু সিবিএস চালু করার স্বার্থে গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে পোস্ট অফিসে ইসিএস বন্ধ। লোকের অভাবে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন বহু পোস্ট অফিসের মাথারা। ভারতীয় গ্রামীণ ডাক-সেবক সংগঠনের রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘বেহাল পরিকাঠামো শুধু নয়। কর্মীরও বড্ড টানাটানি। অনেক সাব পোস্ট অফিসে তো স্থায়ী পোস্টমাস্টার পর্যন্ত নেই! অন্য জায়গা থেকে লোক পাঠিয়ে কাজ সামলাতে হচ্ছে।’’ উপরমহলকে ওঁরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?

সিপিএমজি’র জবাব, ‘‘খেপে খেপে প্রচুর কর্মী নেওয়া হয়েছে। কম্পিউটার-ভিত্তিক কাজকর্মের সঙ্গে যাঁদের মানিয়ে নিতে অসুবিধে, তাঁদের জন্য দফায় দফায় ট্রেনিং ক্যাম্প হচ্ছে।’’ সমস্যা থাকলে ডাককর্মীদেরই তা গ্রাহককে বুঝিয়ে বলা উচিত বলে সিপিএমজি মনে করেন।

তবে সংসার চালানো বা চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিজের সঞ্চয়ের টাকা হাতে পাচ্ছেন না যাঁরা, তাঁদের ‘বুঝিয়ে’ কতটা লাভ হবে, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ ডাক মহলের অন্দরেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE