Advertisement
০২ মে ২০২৪

উচ্চশিক্ষা কব্জায় আনতে বিলের নাগপাশ

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ বা পুনর্নিয়োগ রদ নিয়ে চাপান-উতোর শেষ হয়নি। তার মধ্যেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চলেছে রাজ্য সরকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ বা পুনর্নিয়োগ রদ নিয়ে চাপান-উতোর শেষ হয়নি। তার মধ্যেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চলেছে রাজ্য সরকার।

শিক্ষক ও কর্মীদের বেতন-সহ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খরচ সামলাতে সরকারই টাকা জোগায়। সেই সুবাদে তারা ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে এত দিন সওয়াল করে আসছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর শুধু মুখের কথা নয়। হস্তক্ষেপের অধিকারকে পাকাপোক্ত করতে পুরো বিষয়টিতেই এ বার আইনি সিলমোহর দিতে চায় সরকার। তাই বিল আনা হচ্ছে বিধানসভার চলতি অধিবেশনেই।

উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) বিল, ২০১৬’ আইনে পরিণত হলে রাজ্য সরকার সব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কেই যে-কোনও বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারবে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় সেই নির্দেশ না-মানলে তাদের অর্থসাহায্য বন্ধও করে দিতে পারে সরকার।

কী থাকছে ওই বিলে?

কী থাকছে না, সেটা খুঁজে বার করাই মুশকিল। শিক্ষকদের হাজিরা থেকে সম্পত্তির হিসেব, যথেচ্ছ বদলি পর্যন্ত সব কিছুতেই সরকারি হস্তক্ষেপের সংস্থান আছে ওই বিলে।

বিধানসভা ও লোকসভার ভোটে প্রার্থী হতে গেলে সম্পত্তির খতিয়ান পেশ করতে হয় নির্বাচন কমিশনের কাছে। তৃণমূল সরকারের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যক্ষ-সহ সব কর্মীরই প্রতি বছর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব দাখিল বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

শিক্ষকদের হাজিরায় কড়াকড়ির কথা বারে বারেই বলে আসছেন শিক্ষামন্ত্রী। এ বার তা আইনসিদ্ধ করছে সরকার। বায়োমেট্রিক হাজিরা পদ্ধতি চালু করা হবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার ইচ্ছে করলেই শিক্ষক-সহ কলেজের কর্মীদের বদলি করে দিতে পারবে। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অন্য কর্মীরা পুরো কার্যকালে এক বার বদলির সুযোগ পাবেন। সেটা আপসের বদলি হতে পারে। সেই সঙ্গে অন্য কলেজে যাওয়ার জন্য আবেদনও করা যাবে।

রাজনৈতিক ব্যক্তির বদলে কোনও শিক্ষাবিদকে কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি-পদে বসানোরকথা বলা হয়েছে বিলে। কিন্তু কোন শিক্ষাবিদকে ওই পদে বসানো হবে, তা-ও ঠিক করে দেবে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের বেড়ি সেখানেও। প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, ‘কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিতে রাজ্যপালের মনোনীত ব্যক্তি কে হবেন, তা ঠিক করতে হবে সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই। এবং সরকারই বলে দেবে, পরিচালন সমিতির মেয়াদ কত দিনের হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগ স্থগিত করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। বিষয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই যে সরকারের এই উদ্যোগ, প্রস্তাবিত বিলে সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, ‘কোনও শিক্ষককে পুনর্নিয়োগ করতে গেলে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে।’ অর্থাৎ কোন কোন শিক্ষক পুনর্নিযুক্ত হবেন, তা সরকারই ঠিক করে দেবে।

এই বিলের সাহায্যে সরকার উচ্চশিক্ষাকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদদের অনেকেই। কেউ কেউ বলছেন, বাম জমানায় শিক্ষার রাশ নিজের হাতে নিয়েছিলেন অনিল বিশ্বাস। বিলের মোড়কে শিক্ষায় সেই ‘অনিলায়ন’-এর ব্যাপারটা‌কেই আরও দৃঢ় করতে চলছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরা। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেছেন, ‘‘এটা তো উচ্চশিক্ষাকে কব্জা করার চেষ্টা! আমি যে-কাউকে ইচ্ছেমতো শাস্তি দিতে পারব, বদলি করতে পারব, আচরণবিধি তৈরি করতে পারব। এটা তো উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপ।’’

বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসন ছাড়া চলতে পারে না বলে মনে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রামপ্রহ্লাদ চৌধুরী। ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের জন্যই স্বশাসন প্রয়োজন। তা নষ্ট হয়ে গেলে বিপদ আছে,’’ বলেন রামপ্রহ্লাদবাবু। ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজের আশঙ্কা, সরকারের এই উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধীন অস্তিত্বই নষ্ট হয়ে যাবে। ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসন হরণের প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়েছিল। এ বার যা হচ্ছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পুরোপুরি রাজ্য সরকারের কুক্ষিগত হয়ে যাবে,’’ বলছেন শ্রুতিনাথবাবু। আর জুটার সাধারণ সম্পাদিকা নীলাঞ্জনা গুপ্তের প্রশ্ন, ‘‘আমাদের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এমন একটা বিল তৈরি হয়ে গেল। এ কেমন গণতন্ত্র?’’

তৃণমূলপন্থী শিক্ষক সংগঠনের চেয়ারপার্সন কৃষ্ণকলি বসু অবশ্য এই বিল নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিল আসছে নাকি? কিছু জানি না তো!’’

শিক্ষাবিদদের অনেকেই অবশ্য বিলের কিছু অংশের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। যেমন ছাত্রভোটের অংশটি। প্রস্তাবিত বিলে লিন্ডো কমিশনের সুপারিশ মেনে কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট আচরণবিধি তৈরির কথা বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থা সমর্থন করেছেন অনেক শিক্ষাবিদ। তাঁদের অনেকের সমর্থন রয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাবেও। অধ্যক্ষকে কলেজের সব কর্মীর বার্ষিক মূল্যায়ন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে ওই বিলে। এই বিষয়টি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE