Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দত্তকের হাজিরায় ক্ষতি শিশুমনেরই

সাধারণ ভাবে নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানসুখের আশায় কোনও শিশুকে দত্তক নেন। আবার নিরাশ্রয় শিশু যাতে বাবা-মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে উঠতে পারে, সেই জন্য তাকে দত্তক দেওয়া হয়। দু’পক্ষের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকে না।

শমীক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৭ ০২:৪৩
Share: Save:

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে দত্তক নেওয়া শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত তাকে নিয়ে এক দম্পতিকে নিয়মিত বিচারকের সামনে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল বর্ধমান জেলা আদালত। সোমবার সেই নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিম্ন আদালতের হাজিরা সংক্রান্ত নির্দেশ খারিজ করতে গিয়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে এ ভাবে হাজিরা দিতে হলে দত্তক নেওয়া সন্তান ক্রমেই বুঝে যাবে, ওই দম্পতি তার প্রকৃত বাবা-মা নন। যে-উদ্দেশ্যে দত্তক নেওয়া হয়ে থাকে, আদালতে এই ধরনের নিয়মিত হাজিরার বন্দোবস্ত সেই উদ্দেশ্য মোটেই পূরণ করবে না।

সাধারণ ভাবে নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানসুখের আশায় কোনও শিশুকে দত্তক নেন। আবার নিরাশ্রয় শিশু যাতে বাবা-মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে উঠতে পারে, সেই জন্য তাকে দত্তক দেওয়া হয়। দু’পক্ষের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকে না। এবং সেই সম্পর্কহীনতার দূরত্ব ক্রমশ ঘুচিয়ে বাবা-মা-সন্তানের সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলাই দত্তক-প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য। শিশুটির চেতনা উন্মেষের প্রতি পদে তাকে যদি সেই দূরত্বের জ্বালা বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে-ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দম্পতি ও সন্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক তো হয়ই না, দত্তক ব্যবস্থার সামাজিক উদ্দেশ্যও পণ্ড হয়ে যায়। আইনজীবী শিবিরের বক্তব্য, উচ্চ আদালত সেটা চাইছে না বলেই এ ক্ষেত্রে সসন্তান দম্পতির নিয়মিত হাজিরার নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছে।

দুর্গাপুরের বাসিন্দা ওই দম্পতি ২০১৪ সালে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে এক বছরের একটি শিশুপুত্রকে দত্তক নেন। তাঁদের আইনজীবী উদয়শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানান, দুর্গাপুর-আসানসোলের ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সব রকম নিয়মবিধি মেনেই শিশুটিকে দত্তক দিয়েছে। ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’ মেনে গত বছর ২২ জুন বর্ধমান জেলা জজের আদালতে শিশুটিকে নিয়ে হাজিরা দেন ওই দম্পতি। জেলা জজ নির্দেশ দেন, শিশুটি যথাযথ যত্নে ও নিরাপদে আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য প্রথমে তিন মাস অন্তর এবং পরে ছ’মাস অন্তর নিয়মিত তাঁর আদালতে দত্তক নেওয়া শিশুপুত্রকে নিয়ে হাজির হতে হবে ওই দম্পতিকে।

দম্পতির আইনজীবী জানান, দত্তক শিশুটিকে নিয়ে তাঁর মক্কেলরা বেশ কয়েক বার জেলা জজের আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের গোড়ায় জেলা জজ আবার নির্দেশ দেন, দত্তক শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত আদালতে নিয়মিত হাজিরা চালিয়ে যেতে হবে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাস পাঁচেক আগে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন ওই দম্পতি। মামলার সঙ্গে যুক্ত করা হয় রাজ্য সরকারকে।

আদালতের খবর, আগের শুনানিতে বিচারপতি আবেদনকারী দম্পতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, শিশুটিকে যে-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে দত্তক নেওয়া হয়েছে, মামলায় তাদেরও যুক্ত করতে হবে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ওই সংগঠনকে মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ দিনের শুনানিতে সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে কোনও আইনজীবী আদালতে হাজির ছিলেন না।

দম্পতির আইনজীবী জানান, বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, এ কথা ঠিক যে, শিশুটির যত্ন হচ্ছে কি না বা সে নিরাপদে আছে কি না, তা জানার জন্যই জেলা নিম্ন আদালত ওই নির্দেশ দিয়েছিল। ওই আদালতের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু ওই দম্পতি যে তার প্রকৃত বাবা-মা নন, সেটা বুঝে গেলে শিশুটির উপরে যে-মানসিক চাপ তৈরি হবে, সে-কথা ভেবেই তিনি হাজিরার নির্দেশ খারিজ করছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE