বিচিত্র আবদারে তাঁর জুড়ি মেলা ভার!
সেই আবদার সামনে চলে আসায় অনেক সময়েই বিপাকে পড়তে হয়েছে তাঁকে। তবু তিনি নাছোড়।
তিনি— শাসকদলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজি।
এ বার আবদার জুড়েছেন, হাওড়ার আমতার রামসদয় কলেজের পরিচালন সমিতিতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এক দলীয় নেতাকে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করতে হবে। যা নিয়ম-বিরুদ্ধ।
গত বছর মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর আবদার ধরেছিলেন মাজিবাবু। সেই আবদার মেনে সরকারি প্রক্রিয়া অনেকটা এগোলেও শেষ পর্বে ভেস্তে যায়। তার পরে আবদার ছিল, ডাক্তারি-পড়ুয়া ছেলের পরীক্ষার সময় পরীক্ষাকেন্দ্রের সিসিটিভি-র ক্যামেরা যেন বন্ধ থাকে এবং ছেলে যেন নিজের মর্জিমাফিক জায়গায় বসে উত্তর লিখতে পারে! সেটাও মানা হয়নি। চলতি বছরের গোড়ায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষায় হবু ডাক্তারদের টোকাটুকিতে ‘মদত’ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ভেস্তে যায় সেই চেষ্টাও! তবু, আবদারে দাঁড়ি পড়েনি।
এ বার স্বাস্থ্য ছেড়ে শিক্ষা!
কোনও কলেজের পরিচালন সমিতিতে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে কাউকে জায়গা পেতে হলে তাঁকে অন্তত স্নাতক হতেই হবে। এটাই মাপকাঠি। বছর চারেক আগে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ কথা জানিয়েছিল উচ্চ শিক্ষা দফতর। এটা জেনেও উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তথা ওই কলেজের সভাপতি নির্মলবাবু বিশ্বনাথবাবুর নাম সম্প্রতি সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে প্রস্তাব করে পাঠান উচ্চ শিক্ষা দফতরে। এ-হেন আবদার পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে ওই দফতর। তাই নির্মলবাবু শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর এই টানাপড়েনে ছ’মাস ধরে আটকে রয়েছে কলেজের পরিচালন সমিতির গঠন প্রক্রিয়া।
নির্মলবাবু যাঁকে ওই কলেজের পরিচালন সমিতিতে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে আনতে চাইছেন, তিনি উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সভাপতি, সত্তরোর্ধ্ব বিশ্বনাথ লাহা। বিশ্বনাথবাবু নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি স্নাতক নন। কিন্তু নির্মলবাবুর দাবি, ‘‘বিশ্বনাথবাবু স্নাতক। তাই তাঁর নাম প্রস্তাব করে উচ্চ শিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়। এতে কোনও অন্যায় নেই।’’
আমতার কলেজটির পরিচালন সমিতির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে গত বছরের অগস্টে। নিয়ম হল নতুন পরিচালন সমিতি তৈরি না হলে পুরনোটিরই মেয়াদ তিন মাস করে বাড়িয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ছ’বারের বেশি মেয়াদ বাড়ানো যায় না। আমতার কলেজটির পুরনো পরিচালন সমিতির মেয়াদ ইতিমধ্যে তিন বার বাড়ানো হয়েছে। নতুন পরিচালন সমিতি গঠনের জন্য বেশির ভাগ পদে মনোনয়নও হয়ে গিয়েছে। শুধু দু’জন সরকারি প্রতিনিধির মনোনয়ন বাকি। শিক্ষা দফতর থেকে নাম দু’টি অনুমোদিত হয়ে এলেই পরিচালন সমিতি গঠিত হয়ে যাওয়ার কথা।
শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারাই নাম দু’টি ঠিক করে দফতরে পাঠান। সেটাই অনুমোদন করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলেজে। আমতার কলেজটির পরিচালন সমিতির সভাপতি যে-হেতু বিধায়ক নিজেই, তাই সেটির সরকারি প্রতিনিধির জন্য দু’টি নাম প্রস্তাব করে পাঠান নির্মলবাবুই। কিন্তু বিশ্বনাথবাবু স্নাতক না হওয়ায় তাঁর নামটি অনুমোদন করা হয়নি। দফতরের কর্তারাই জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েই নির্মল শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারস্থ হন। কিন্তু মন্ত্রীর থেকে কোনও উত্তর না আসায় এ বিষয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তাঁরা।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর কাছে এ সংক্রান্ত কোনও অনুরোধ আসেনি। তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে শিক্ষা দফতরের বক্তব্য পরিষ্কার। দফতরের নির্দেশিকার বাইরে গিয়ে কাউকেই কলেজের সরাকরি প্রতিনিধি করা যাবে না।’’
এই পরিস্থিতিতে দ্রুত নতুন পরিচালন সমিতি তৈরি না হলে কলেজ পরিচালনায় সমস্যা হবে বলে মনে করছেন সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই একাংশ। কলেজের অধ্যক্ষ দেবকুমার মুখোপাধ্যায় জানান, উচ্চ শিক্ষা দফতর থেকে দু’জন সরকারি প্রতিনিধির নাম মনোনীত হয়ে না আসায় পুরনো সমিতিরই মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে।
কী বলছেন বিশ্বনাথবাবু?
ওই তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘আমি ওই কলেজের প্রাক্তনী। ১৯৫৮ সালে স্নাতক স্তরে পড়ার সময়েই একটি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় কলেজ ছাড়তে হয়। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসা করি।’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘বিধায়ক আমাকে বলেছিলেন, কলেজের পরিচালন সমিতিতে আপনাকে আসতে হবে। তার পরে কী হয়েছে জানি না।’’ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদ্বিরে কথা এড়িয়ে গিয়ে নির্মলবাবু বলেন, ‘‘বিশ্বনাথবাবু এক সময়ে অ-বাম ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তাঁর ফাইল উচ্চ শিক্ষা দফতর হারিয়ে ফেলেছে। ফলে, আবার নতুন করে ফাইল পাঠাচ্ছি।’’
বিরোধীরা অবশ্য নির্মলবাবুর নতুন আবদারে অবাক হচ্ছেন না। তাঁরা মনে করছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেই নির্মলবাবুর ‘সাহস’ দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমতার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রত্যুষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘নির্মলবাবু যে সব কাণ্ড-কারখানা করেন, তাতে এটা অপ্রত্যাশিত নয়। শিক্ষা দফতরের নিয়ম মানা উচিত।’’ এলাকার বর্তমান বিধায়ক কংগ্রেসের অসিত মিত্র বলেন, ‘‘বিশ্বনাথবাবুর নাম প্রস্তাব করা হয়ে থাকলে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এতে শিক্ষা জগতেরই ক্ষতি।’’
কিন্তু নির্মলবাবু গোঁ ছাড়তে নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy