Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
State News

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ইতিহাস গড়ে পৌনে ২ কোটি ভোটারকে বঞ্চিত করা হল

সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা কায়েম হওয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত হল সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। বিশেষ করে সমাজের তিনটি শ্রেণি— মহিলা, তপশিলি জাতি এবং উপজাতি শ্রেণির অংশগ্রহণ।

এই ভাবেই  তাণ্ডব দেখিয়ে ভোটারদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ভোট প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হল। ফাইল চিত্র।

এই ভাবেই তাণ্ডব দেখিয়ে ভোটারদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ভোট প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হল। ফাইল চিত্র।

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ২০:৫০
Share: Save:

২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল। উন্নয়নের প্রশ্নকে সামনে রেখে শাসক দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের যে ইতিহাস গড়ে তুলল, তা এক কথায় নজিরবিহীন! শাসক দল উন্নয়ন করেছে, তাই একশো শতাংশ পঞ্চায়েত আসনে জয়ের হকদার, এই ভাবনা রাজ্যের বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে অস্বিত্বের সংকট তৈরি করেছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় উন্নয়ন বলতে শুধুই রাস্তাঘাট বা পরিকাঠামোগত উন্নয়ন বোঝায় না, স্থানীয় স্তরের উন্নয়নের মধ্যে মানবসম্পদের উন্নয়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবসম্পদের উন্নয়ন বলতে বোঝায় পঞ্চায়েতের কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণ আর সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। রাজ্য জুড়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে ৩৪ শতাংশ আসন শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ায় পাঁচ কোটি ভোটারের মধ্যে এক কোটি ৭৫ লক্ষ ভোটারই ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেন। তারই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্দল প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ হারালেন।

সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা কায়েম হওয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত হল সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। বিশেষ করে সমাজের তিনটি শ্রেণি— মহিলা, তপশিলি জাতি এবং উপজাতি শ্রেণির অংশগ্রহণ। গত এক মাস ধরে বাঁকুড়া, বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদের একটা বড় অংশে শাসক দলের বাধায় সমাজের পিছিয়ে পড়া এই তিন শ্রেণির অনেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। সেই অংশগ্রহণ শুধুই প্রার্থী হিসেবে নয়, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষ ভোটগ্রহণ, ভোটদান— নানা ভাবে যুক্ত হতে চান। নির্বাচনের সেই গোটা প্রক্রিয়া থেকেই রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার ১ কোটি ৭৫ লক্ষ ভোটদাতাকে দূরে সরিয়ে রাখা হল।

অর্থনীতিশাস্ত্র অনুসারে উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তই হল, নাগরিকদের অংশগ্রহণ। আর সেই নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে স্থানীয় স্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। রাজ্যের শাসক দলের কাছে উন্নয়নের অর্থ হল, ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ সম্পর্ক। তার মানে, শাসক দল এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের দাতা আর ভোটাররা হলেন উন্নয়নের গ্রহীতা। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেস যেহেতু মানুষদের সুফল দিয়েছে, তাই একমাত্র তৃণমূলেরই জয়ের অধিকার আছে। এই ভাবনা থেকেই শাসক দলের নেতৃত্ব ১০০ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন দখলের ডাক দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ১০০ শতাংশ আসন জেতার কথা বলেছিলেন। রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী বিরোধী-শূন্য পঞ্চায়েতের ডাক দিয়েছিলেন। যে সব পঞ্চায়েত বিরোধী-শূন্য হয়ে উঠতে পারবে, তাদের ইনাম হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন!

আরও পড়ুন- সিপিএম পদ্ম আঁকছে, কটাক্ষ

আরও পড়ুন- ‘নিজের ভোট এ বারও নিজেই দেব’, শতবর্ষ পার করেও অবিচল বৃদ্ধ​

উন্নয়নের তাত্ত্বিকরা বলেন, উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্প্রসারণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে উন্নয়ন। অথচ, পশ্চিমবাংলার শাসক দল যে উন্নয়নের কথা বলছেন তা কিন্তু ব্যক্তিকে অন্যের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে! তাতে অনিবার্য ভাবেই, গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ উন্নয়নের সঙ্গে আত্মসম্মানের সম্পর্ক দেখেন। তাঁদের অভিমত হল, প্রকৃত উন্নয়ন মানুষের আত্মমর্যাদা বাড়াবে। আর সেই আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে স্বাধীন বিকাশের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠবে। তৃণমূলের উন্নয়নের মডেল কতটা মানুষের আত্মমর্যাদা বিকাশে সাহায্য করছে সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ‘উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে’ এই জাতীয় স্লোগানের যে প্রয়োগ রাজ্যের মানুষ দেখলেন, তা কিন্তু একেবারেই সুস্থ গণতন্ত্রের সহায়ক নয়। মনোনয়ন পর্বে বিভিন্ন বিডিও এবং মহকুমা আধিকারিকদের অফিস যে ভাবে শাসক দলের লেঠেল বাহিনী পাহারা দিয়ে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখল, তাতে তিনটি জেলা পরিষদ, প্রায় ১২৫টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং বিভিন্ন জেলায় ১১২৫টির মতো গ্রাম পঞ্চায়েত শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করল বটে, কিন্তু আগামী দিনে এই লেঠেল বাহিনী গ্রাম পঞ্চায়েতের দৈনন্দিন কাজে যে খবরদারি করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

এ বার আসা যাক, গণতন্ত্রকে লুণ্ঠন করে কারা কারা জেলাগুলি থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন (যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে তাঁদের ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীদের একটা বড় অংশই বেআইনি, অসংগঠিত কারবারের মালিক। বীরভূমের ক্ষেত্রে যদি তাঁরা বালি এবং খাদানের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তবে বাঁকুড়া এবং পশ্চিম বর্ধমানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের অনেকেই বেআইনি কয়লা খননের কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমায় ভাড়োয়া, সন্দেশখালি, হিন্দোলগঞ্জ, মিনাখাঁয় যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতলেন, তাঁরা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু, এঁদের একটা অংশের সঙ্গে ও-পার বাংলায় চোরা পথে ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ। একই ভাবে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং মহকুমায় ভাঙড় সহ বিস্তীর্ণ অংশে যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতলেন, তাঁদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানো এবং বেআইনি খনি কারবারের সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ। মালদহ-মুর্শিদাবাদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীদের কারও কারও বিরুদ্ধে যেমন গরুপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে, তেমন কারও বিরুদ্ধে নোট-জালিয়াতি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকারও অভিযোগ উঠছে।

স্থানীয় স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে ভাবে রাজনীতির অভিমুখ ছেড়ে অর্থনীতির উপাদানের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছবে সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে।

সাংবিধানিক সংস্থাগুলির যথার্থ ভূমিকা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গে বার বার প্রশ্ন উঠছে। সংবিধানের ২৪৩-কে ধারা অনুসারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। এই নির্বাচনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক দলগুলি নয়, মহামান্য আদালতও কিন্তু বার বার সমালোচনা করেছে। সকলের মনোনয়ন সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব যে কমিশনের, সেই কমিশনই এমন ভূমিকা নিয়েছে, যা নাগরিকদের পছন্দের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছে বলে অভিযোগ। কুড়ি হাজারেরও বেশি আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি দেখেও রাজ্য নির্বাচন কমিশন কোনও কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে। বরং, বার বার নির্বাচন কমিশনকে দেখা গিয়েছে, ই-মনোনয়ন পত্র যাতে না গ্রহণ করতে হয়, সেই বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে।

নাগরিক সমাজ থেকে স্থানীয় স্তরে গণতন্ত্র হরণ প্রক্রিয়ায় মৃদু সমালোচনা উঠে এলেও, নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশও কিন্তু এই বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেনি। দিনের পর দিন বিভিন্ন জেলায় মহিলারা লাঞ্ছিত হলেও মহিলা কমিশন বা মহিলা সংগঠনগুলির কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। কোনও উদ্যোগ নেননি রাজ্য মানবাধিতার কমিশনও। তফশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য তৈরি কমিশনও কার্যকর কোনও ভূমিকা নিতে পারেনি। অথচ, সুস্থ গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তই হল, জাগ্রত নাগরিক সমাজের উপস্থিতি এবং স্বাধীন সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সাংবিধানিক সংস্থাগুলির চোখে পড়ার মতো ভূমিকা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE