Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
দোরগোড়ায় ফের সিবিআই

নজরে তৃণমূলের ১৯, ভোটের মুখে আবার তেড়েফুঁড়ে তদন্ত

গত ১৯ নভেম্বরের ঘটনা। দিল্লিতে সিবিআই-ইন্টারপোলের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। বিরতির সময় সিবিআইয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্তা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন, ‘‘খবর পেয়েছেন তো? মদন মিত্রর জামিন নাকচ!’’ তার পর চোখ টিপে বললেন, ‘‘পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!’’

সন্দেশখালিতে সরকারি সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: নির্মল বসু।

সন্দেশখালিতে সরকারি সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: নির্মল বসু।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৪
Share: Save:

গত ১৯ নভেম্বরের ঘটনা। দিল্লিতে সিবিআই-ইন্টারপোলের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। বিরতির সময় সিবিআইয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্তা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন, ‘‘খবর পেয়েছেন তো? মদন মিত্রর জামিন নাকচ!’’ তার পর চোখ টিপে বললেন, ‘‘পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!’’

সিবিআইয়ের অন্দর মহলের খবর, এই ‘বাকি পিকচার’ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য মোটেই সুখকর নয়। কারণ তৃণমূলের ৯ জন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস পাঠাতে চলেছে সিবিআই। এঁদের মধ্যে দু’এক জনকে গ্রেফতার করার সম্ভাবনাও প্রবল বলে সিবিআই সূত্রের খবর।

তবে এই ৯ জনেই শেষ নয়। সব মিলিয়ে অন্তত ১৯ জনের নাম রয়েছে সিবিআইয়ের কাছে। যাঁদের জেরা করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে সাক্ষী হিসেবে আগেও জেরা করেছে সিবিআই। এ বার জেরা করা হবে অভিযুক্ত হিসেবে।যাঁদের মধ্যে রাজ্যের এক মন্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়, বেশ কয়েক জন সাংসদও নেতার নাম রয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।

বিধানসভা ভোটের আর মেরেকেটে মাস ছয়েক বাকি। ঠিক তার আগে সিবিআইয়ের এই নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠার পিছনে কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখছেন অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, বিজেপির ‘স্ট্র্যাটেজি ফর ওয়েস্ট বেঙ্গল ২০১৬’-এর অন্যতম অঙ্গই হল সিবিআইকে কাজে লাগানো। রাজ্যে বিধানসভার ভোট যত এগিয়ে আসছে, সারদা কাণ্ড নিয়ে ততই তৃণমূলের অন্দরে নিজেদের থাবা একটু একটু করে বসাতে চাইছে সিবিআই। রাজ্যের এক বিরোধী নেতার মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল নেত্রী যেমন নির্বাচনের তাগিদেই বৃহস্পতিবার সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সভায় গিয়েছিলেন, ঠিক তেমন ভাবেই ভোটের ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপিও সিবিআইকে দিয়ে তৃণমূলকে চাপে ফেলারকৌশল নিয়েছে।’’


সবিস্তারে পড়তে ক্লিক করুন...

এত দিন সিবিআই তদন্ত খানিকটা ঝিমিয়ে থাকায় সিপিএম-কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছিল, ‘দিদিভাই-মোদীভাইয়ের’ বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিধানসভা ভোটের আগে সিবিআই যে তৎপর হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে তৃণমূল নেতাদের আশঙ্কা ছিলই। তাঁদের বক্তব্য, এই আশঙ্কা থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘আমার পিছনে কেউ যদি সিবিআই লাগায়, লাগাক! জেলে যেতে আমি ভয় পাই না।’’ যদিও মুখ্যমন্ত্রী জনসভায় ‘ভয় পাই না’ বললেও তাঁর দলের নেতাদের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় অন্য কথাই বলেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, সিবিআই গুরুত্বপূর্ণ তৃণমূল নেতাদের তলব করা শুরু করলে ভোটের সময় অস্বস্তিই বাড়বে দলের।

কাদের তলব করতে পারে সিবিআই?

সংস্থা সূত্রে খবর, ওই তালিকায় নাম রয়েছে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়র। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে তৃণমূলের বেশ কয়েক জন সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে রাজনীতিতে এসে তৃণমূলে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের নামও রয়েছে ওই তালিকায়। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, এঁরা কেউ নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সারদার সুদীপ্ত সেন বা রোজ ভ্যালির গৌতম কুণ্ডুকে সুবিধে করে দিয়েছেন। কেউ সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার পদে থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন। কেউ আবার নিজেদের আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠদের ওই সব সংস্থার পদে বসিয়ে দিয়েছেন।

সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরেও সারদার বিভিন্ন সংস্থা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। সিবিআই জানতে পেরেছে, বকলমে তৃণমূলের কিছু নেতাই এই সংস্থাগুলি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কোনও স্বার্থ না থাকলে, রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদরা কেন একটি বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব নিয়ে সেটিকে চালু রাখবেন, এই প্রশ্ন ধরেই এগোচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।

সিবিআই সূত্রের খবর, গোলপার্কের একটি ব্যাঙ্কের শাখায় তল্লাশি চালিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, সেখানে সারদার একটি অ্যাকাউন্ট থেকে বেশ কিছু রহস্যময় লেনদেন হয়েছে। ওই টাকা ঘুরপথে প্রভাবশালীদের কাছেই গিয়েছে বলে সিবিআইয়ের সন্দেহ। এ বিষয়ে বর্তমানে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক তৃণমূল সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান তদন্তকারীরা। রাজ্যের এক মন্ত্রী কিছু দিনের জন্য সারদার একটি পত্রিকা চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি ও তাঁর আত্মীয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সারদা ও রোজ ভ্যালি আবাসন ও পর্যটন ব্যবসায় নেমেছিল। ওই পুরসভাগুলিতে তৃণমূল ক্ষমতাসীন থাকায় তাদের ছাড়পত্র পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তার জন্য শাসক দলের নেতা ও তাঁদের আত্মীয়দের কোটি কোটি টাকা গুনে দিতে হয়েছিল বলে সুদীপ্ত সেন জেরায় সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেছেন। সেই সূত্র ধরেও কয়েক জন তৃণমূল নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। আবার সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তৃণমূলের কয়েক জনকেও ডাকা হতে পারে বলে সিবিআইয়ের একটি সূত্রের খবর।

নেতাদের ডাকার সম্ভাবনা নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে, সিবিআইয়ের কর্তারা অবশ্য তার মধ্যে ঢুকতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, হঠাৎ কোনও রাজনৈতিক চাপে নড়েচড়ে বসা নয়, এত দিন ধরে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নানা তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছেন তাঁরা।পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করার পরেই আরও বেশ কিছু প্রভাবশালীকে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি, গত কয়েক মাস ধরে তারা কোনও প্রভাবশালীকে জেরা করেনি ঠিকই। কিন্তু এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত বহু সাধারণ মানুষকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এঁদের কেউ সারদার কর্মী, কেউ গাড়িচালক, কেউ অন্য কোনও পেশায় রয়েছেন। এঁদের অনেকেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য দিয়েছেন। কেউ লেনদেনের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গোটা পর্ব নিজের চোখে দেখেছেন। আবার কারও হাত দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের এক অফিসারের কথায়, ‘‘এই সব মানুষদের অনেককেই সেই সময়ে কোনও গুরুত্ব দেননি লগ্নি সংস্থার কর্তা বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। অতি নগণ্য এই মানুষগুলোও যে এক দিন তাঁদের কীর্তির কথা খুলে বলতে পারেন, এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি প্রভাবশালীরা। এতটাই ওঁরা আত্মতুষ্ট ছিলেন।’’ তদন্তকারী অফিসারের সামনে দেওয়া এই সাধারণ মানুষদের গোপন জবানবন্দিই এখন সিবিআইয়ের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। গোয়েন্দাদের দাবি, এই সব নথি ও তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই ক্রমশ গতি বেড়েছে সারদা তদন্তের। তবে কৌশলগত কারণে এই নথিপত্রের পুরোটা আদালতে জমা করেনি সিবিআই। শুধুমাত্র কেস ডায়েরিতেই এর উল্লেখ রাখা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর।

শুধু এই সব সাক্ষ্য নয়, রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটি ‘পেন ড্রাইভ’ থেকেও বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে সিবিআইয়ের দাবি।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁদের নিয়ে সারদার বিভিন্ন অফিস ও বাড়িতে হানা দিয়েছিল রাজ্য পুলিশ। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অনেক নথি ও পেন ড্রাইভ। পরে দেবযানী-সুদীপ্তকে জেরা করে ওই সব নথি ও পেন ড্রাইভের কথা সিবিআই-ও জানতে পারে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের কাছে সেগুলি চান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, ‘‘নথিপত্র দেওয়া নিয়ে মাসখানেক খুবই গ়ড়িমসি করেছিলেন ‘সিট’ (রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল)-এর অফিসারেরা। পরে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ৩১৮টি ফাইল ও কয়েকটি পেন ড্রাইভ আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’’ সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সব পেন ড্রাইভ ও ফাইল খুঁটিয়ে দেখার পরে তিনটি পেন ড্রাইভ ও ৬২টি ফাইলকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে আলাদা করা হয়।

কী রয়েছে ওই পেন ড্রাইভ ও ফাইলে?

সিবিআই সূত্রের খবর, সারদা কর্তার কাছে শাসক দলের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতা টাকা চেয়ে যে সব সুপারিশ-চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তার বেশ কিছু প্রমাণ রয়েছে ওই সব পেন ড্রাইভে। এ ছাড়া রয়েছে সারদার সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার চুক্তিপত্রও। বিভিন্ন সময়ে শাসক দলের নেতাদের দেওয়া টাকার অঙ্ক উল্লেখ করে সুদীপ্তের হাতে লেখা প্রচুর কাঁচা রসিদও পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করছেন সিবিআইয়ের। এক তদন্তকারীর দাবি, ২০১১ ও ২০১২ সালে দুর্গাপুজো বাবদ রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী কয়েক দফায় বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে সুদীপ্তের হাতে লেখা কাঁচা রসিদ থেকে জানা যাচ্ছে। টাকা চেয়ে ওই মন্ত্রীর সুপারিশের চিঠিও রয়েছে ওই সব ফাইল ও পেন ড্রাইভে।

সিবিআই অফিসারদের দাবি, সারদা-রোজ ভ্যালি কেলেঙ্কারির ব্যাপ্তি এতটাই যে, আর পাঁচটা আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে এর অনেক ফারাক রয়েছে। তার উপরে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষেরা। সুপ্রিম কোর্ট এই সব মানুষদেরই খুঁজে বের করতে বলেছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘কয়েক হাজার কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে প্রথম আমাদের দিশাহারা অবস্থা হয়েছিল। রোজ ভ্যালির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সংখ্যাটাই ছিল কয়েক হাজারের উপরে।’’ সিবিআইয়ের দাবি, এত সব নথিপত্র খুঁটিয়ে দেখতে অনেক সময় চলে গিয়েছে। এর মধ্যেই যখন, যাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট নথিপত্র হাতে এসেছে, তখনই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ আর এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘আমাদের কাগজপত্র নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়। সে সব করতে অনেক সময় কেটেছে। কাউকে গ্রেফতার করা মুখের কথা নয়। কাউকে আদালতে পেশ করার সময়ে নির্দিষ্ট কারণ ও তথ্যপ্রমাণ দেখাতে হয়। পাক্কা প্রমাণ না পাওয়া গেলে কি মদন মিত্রের মতো প্রভাবশালীকে এত দিন ধরে জেলে রাখা সম্ভব?’’ তদন্তকারীদের দাবি, এ রকম ‘পাক্কা প্রমাণ’ পেলে তবেই অন্য প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সিবিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cbi 19 saradha scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE