Advertisement
০৮ মে ২০২৪
বিষ্ণুপুর মেলায় বিশৃঙ্খলা

মঞ্চ কার, হাতাহাতি দুই গোষ্ঠীর

শনিবার বিষ্ণুপুর মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছন্দপতন হল পুরপ্রধান ও বিধায়ক অনুগামীদের মঞ্চ দখলের লড়াইয়ে। র‌্যাফ নামিয়ে ধাক্কা মেরে দুই নেতার অনুগামীদের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হল।

সূচনা: মঞ্চে দুই নেতার অনুগামীদের দাপাদাপি। সামলাতে নামল র‌্যাফ। চলল লাঠি। ছবি: শুভ্র মিত্র

সূচনা: মঞ্চে দুই নেতার অনুগামীদের দাপাদাপি। সামলাতে নামল র‌্যাফ। চলল লাঠি। ছবি: শুভ্র মিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:২২
Share: Save:

ফিতে-নারকেল ফর্মুলা কাজে এল না।

শনিবার বিষ্ণুপুর মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছন্দপতন হল পুরপ্রধান ও বিধায়ক অনুগামীদের মঞ্চ দখলের লড়াইয়ে। র‌্যাফ নামিয়ে ধাক্কা মেরে দুই নেতার অনুগামীদের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হল। জাতীয়স্তরের স্বীকৃতি পাওয়া ঐতিহ্যমণ্ডিত ৩০তম বিষ্ণুপুর মেলা এতে কলুষিত হল বলেই মনে করছেন অনেকে। যদিও পুরপ্রধান শ্যাম মুখোপাধ্যায় ও বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য নিজেদের অনুগামীদের হয়ে সাফাই গেয়েছেন। দু’পক্ষের গোলমালে আহত হয়েছেন এসডিপিও ও তিন কনস্টেবল।

এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) সুকমলকান্তি দাস বলেন, ‘‘দু’পক্ষের মারামারি থামাতে গিয়ে তিন জন কনস্টেবল আহত হয়েছেন। আমার হাতেও চোট লেগেছে। পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করায় পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা রুজু করছে।’’

মেলা কমিটির সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য বলছেন, ‘‘মঞ্চে কিছু অযাচিত লোকজন উঠে যাওয়ায় পুলিশ কর্মীরা কেবল তাঁদের সরিয়ে দিয়েছেন। এর বেশি কিছু হয়নি। এ ধরনের ঘটনা কমবেশি সব জায়গাতেই ঘটে।’’

প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যাম মুখোপাধ্যায় গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের কাছে হারার পর থেকেই দু’জনের আকচাআকচি শুরু। তুষারবাবুর শাসকদলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পরে সেই দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে। গত ক’বছরে শ্যামবাবু ধীরে ধীরে দলে যতটা কোণঠাসা হয়েছেন, তুষারবাবুর গোষ্ঠী বিষ্ণুপুরে ততই প্রভাব বাড়িয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সফরে এসে শ্যামবাবুকে দলের চেয়ারম্যান করতেই ফের তাঁর অনুগামীরা তেড়েফুঁড়ে উঠেছেন বলে বাসিন্দাদের মত।

বিষ্ণুপুর মেলার আমন্ত্রণ পত্রে হঠাৎ করে শ্যামবাবুকে প্রধান অতিথি করে মঞ্চের ফিতে কাটার সম্মান দেওয়া হচ্ছে জানতে পেরেই ফুঁসে ওঠেন তুষারবাবু ও তাঁর ঘনিষ্ঠেরা। মেলা কমিটি থেকে তাঁরা পদত্যাগ করেন। পরিস্থিতি সামলাতে কমিটির সভাপতি ঘোষণা করেন, তুষারবাবু নারকেল ফাটিয়ে মেলার পদযাত্রার সূচনা করবেন। এতে তাঁরা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করায় অনেকে ভেবেছিলেন, সঙ্কট কাটল।

কিন্তু শনিবার বিষ্ণুপুর দেখল, সে সব ভুল। বিধায়ক যে নারকেল ফাটাবেন, সে কথা কেন অনুষ্ঠান-সূচিতে রাখা হয়নি, তা নিয়ে দিনের শুরুতেই চাপা অভিযোগ উঠতে শুরু করে। শেষে অনুষ্ঠান-সূচি সংশোধন করে ক্ষোভ সামাল দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরে যে আরও কাণ্ড অপেক্ষা করছে, কেউ আঁচ করেননি।

পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাশাপাশি দেখা গেল শ্যাম-তুষারকে। ছবি: শুভ্র মিত্র

বিকেলে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার মাঠ থেকে সভাধিপতি অরূপবাবু, উপপুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়দের পাশে নিয়ে বিধায়ক নারকেল ফাটিয়ে লোকশিল্পীদের নিয়ে পদযাত্রার সূচনা করেন। পুরপ্রধানকে সেখানে দেখতে না পেয়ে অনেক অভিজ্ঞের কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ততক্ষণে পুরপ্রধান পুরভবন থেকে নিজের অনুগামী ও সমর্থকদের নিয়ে পৃথক মিছিল করে মেলার মঞ্চ বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের মাঠের দিকে রওনা দিয়েছেন। সেখানে পৌঁছে ফাঁকা মঞ্চ দেখে শ্যামবাবুর সঙ্গেই তাঁর অনুগামীরা চেয়ারে বসে পড়েন। যাঁরা জায়গা পাননি, তাঁরাও মঞ্চের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

মিনিট কুড়ি পরে সেখানে এসে সব দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তুষারবাবুর অনুগামীরা। অতিথিদের সঙ্গে তাঁরাও মঞ্চে উঠে পড়েন।

দু’পক্ষের লোকজন মুখোমুখি হতেই, মঞ্চ দখলের জন্য শুরু হয়ে যায় ধাক্কাধাক্কি। প্রমাদ গোনেন উদ্যোক্তারা। শুকনো মুখ করে বসে থাকেন বাঁকুড়ার সাংসদ অভিনেত্রী মুনমুন সেন-সহ অতিথিরা। শ্যামবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের অনুগামীদের শান্ত হতে বলেন। মাইক্রোফোন হাতে অরূপবাবুকে বলতে শোনা যায়— ‘‘আমন্ত্রণ পত্রে যাঁদের নাম আছে, তাঁরাই থাকবেন। বাকিরা নেমে যান।’’ কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা!

এসডিপিও র‌্যাফ নিয়ে মঞ্চে উঠে ধাক্কা মেরে দু’পক্ষের লোকেদের দু’দিকে নামিয়ে দেন। সেখানেও তাঁদের সামলাতে নাকাল হন পুলিশ কর্মীরা। লাঠিচার্জ করে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়। আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিশৃঙ্খলা চলার মধ্যে দর্শকদের অনেকে আতঙ্কে ছেলেপুলেদের নিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যান। যদিও অরূপবাবুর মন্তব্য, ‘‘এত বর্ণময় সূচনা অনুষ্ঠান আগে বিষ্ণুপুরে হয়নি। লোকজন খুব সমাদর করেছেন।’’

কিন্তু বিষ্ণুপুরবাসীর আক্ষেপ— ‘‘এত বছরের মেলায় এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। এতে কি পর্যটকদের কাছে বিষ্ণুপুরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হল?’’

তুষারবাবুর দাবি, ‘‘আগেও অন্য অনুষ্ঠানে ওরা এমনটা করেছে। এ দিন ওরা যে ভাবে মঞ্চে দাপাদাপি করছিল, মুনমুনের জন্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল। মঞ্চেই আমার অনুগামীদের মারধর করা হয়। প্রশাসন না থাকলে কী হতো, ভাবতে পারছি না।’’

যদিও শ্যামবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘মঞ্চে শুধু আমার কাউন্সিলরেরাই উঠেছিলেন। অন্য কেউ নয়। কাউকে মারধরও করা হয়নি। বরং মঞ্চের নীচে আমার অনেক লোককে র‌্যাফ মারধর করেছে। আমি চেয়েছিলাম, অনুষ্ঠানের সূচি থেকে আমার নাম কেটে দিক। তাতে যদি শান্তি থাকে, থাকুক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Group Clash TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE