Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রসূতি-মৃত্যুর এগারো বছর পরে ক্ষতিপূরণ

বছর দশেক আগে পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে হুগলির গুড়াপে একটি নার্সিংহোম বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। নার্সিংহোম তাতে কর্ণপাত করেননি। সেখানেই এক প্রসূতির মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিল রাজ্য ক্রেতা আদালত।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:০১
Share: Save:

বছর দশেক আগে পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে হুগলির গুড়াপে একটি নার্সিংহোম বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। নার্সিংহোম তাতে কর্ণপাত করেননি। সেখানেই এক প্রসূতির মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিল রাজ্য ক্রেতা আদালত।

রাজ্য জুড়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বন্যা এবং তার মোকাবিলায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া অবস্থানের পাশাপাশি ক্রেতা আদালতের এই ভূমিকায় আশ্বাস খুঁজে পাচ্ছেন রোগী এবং তাঁদের ভুক্তভোগী আত্মীয়স্বজন। সময়মতো চিকিৎসা না-করে প্রসূতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ জেলা ক্রেতা আদালতের সঙ্গে সঙ্গে জেলা স্বাস্থ্য দফতরেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের নির্দেশ সত্ত্বেও গুড়াপের নার্সিংহোমটি কী ভাবে চলছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি।

স্বাস্থ্য শিবির সূত্রের খবর, প্রসবের জন্য ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ ওই নার্সিংহোমে ভর্তি হন স্থানীয় খড়ুয়া গ্রামের বাসিন্দা মীনাক্ষী কোলে। তাঁর স্বামী তপন কোলের অভিযোগ, নার্সিংহোমের উপরতলাতেই থাকেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসক প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু মীনাক্ষীকে তিনি দেখতে আসেন ভর্তির প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। তার আগেই নার্সিংহোমের শয্যাতেই পুত্রসন্তান প্রসব করেন মীনাক্ষী। তপনবাবুর অভিযোগ, প্রসবের সময় কোনও চিকিৎসক বা নার্স উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন শুধু এক জন আয়া। প্রসবের পরে জরায়ু থেকে অত্যধিক রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ায় নেতিয়ে পড়েন মীনাক্ষী।

প্রণববাবু এসে সেই অবস্থাতেই মীনাক্ষীকে হাঁটিয়ে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যান বলে তপনবাবুর অভিযোগ। ‘‘অপারেশন থিয়েটার থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পরে আমার স্ত্রীকে যখন বার করা হয়, তত ক্ষণে তাঁর অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছে,’’ বললেন তপনবাবু। তা সত্ত্বেও প্রণববাবু ওই প্রসূতিকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সে-দিন দুপুরে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে মীনাক্ষীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। হুগলির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে গুড়াপের ওই নার্সিংহোম ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ দায়ের করেন তপনবাবু। সেই বছরেই হুগলি জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলাও করেন তিনি। ২০০৭-এ নার্সিংহোম বন্ধ করার নির্দেশ দেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। কিন্তু তার পরেও নার্সিংহোম বন্ধ করা হয়নি।

আরও পড়ুন: ডাক্তার নেই, ফি আছে! বিলের অঙ্কে গোঁজামিল ঢাকতে তৎপর হাসপাতাল

২০১৪-র জানুয়ারিতে জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালত অভিযুক্ত চিকিৎসক এবং তাঁর নার্সিংহোমকে ১৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তপনবাবুর মামলার খরচ হিসেবে আরও ৫০ হাজার টাকা মিটিয়ে দিতে বলেন বিচারক। সেই সঙ্গে অবৈধ ব্যবসা চালানোর শাস্তি হিসেবে নার্সিংহোমের আরও সাড়ে চার লক্ষ টাকা জরিমানা করেন তিনি।

সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রণববাবু রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যান। ২০১৬ সালে জেলা আদালতের নির্দেশ খারিজ করে দেয় রাজ্য আদালত। তপনবাবু ওই বছরেই জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন। ২০১৬-র ২০ অক্টোবর জাতীয় আদালতের বিচারপতি ভি কে জৈন তিন মাসের মধ্যে মামলাটির নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন রাজ্য আদালতকে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত মৃতার স্বামীকে ক্ষতিপূরণ মেটানোর নির্দেশ দেয়।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, প্রসূতির চিকিৎসায় দেরি হয়েছিল। জরায়ু থেকে অত্যধিক রক্তক্ষরণ ঠেকাতে ওষুধ, ইঞ্জেকশন তো ছিলই। সেগুলো কাজ না-করলে জরায়ু কেটে বাদ দিয়েও রোগিণীকে বাঁচানো যেত।’’ রোগিণীর অত্যধিক রক্তক্ষরণের পরে তাঁকে রক্ত দেওয়া যে জরুরি ছিল, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চৈতালী রায়ের বক্তব্যেও সেটা স্পষ্ট। ‘‘রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করে তবেই ওই প্রসূতিকে স্থানান্তরিত করা উচিত ছিল,’’ বলছেন চৈতালীদেবী।

তবে প্রায় এক যুগের আইনি টানাপড়েনের পরেও অভিযুক্ত চিকিৎসক প্রণববাবুর দাবি, ‘‘আমি ঠিক চিকিৎসাই করেছিলাম। রাজ্য আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবার জাতীয় আদালতে যাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Consumer Forum Nursing Home Pregnant Compensation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE