Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
খুনের অভিযোগ বাবার

সিপিএম এজেন্টের দেহ লাইনে, বাড়ছে রহস্য

দু’দিন ধরে এমনিতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বিতর্কেরও শেষ নেই। বিধাননগর পুরভোটের উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দিল রেললাইনে পড়ে থাকা সিপিএমের এক নির্বাচনী এজেন্টের রক্তাক্ত দেহ।

ছেলের দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে়ছেন উজ্জ্বলের বাবা-মা। (ইনসেটে) উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। ছবি: শৌভিক দে

ছেলের দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে়ছেন উজ্জ্বলের বাবা-মা। (ইনসেটে) উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

দু’দিন ধরে এমনিতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বিতর্কেরও শেষ নেই। বিধাননগর পুরভোটের উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দিল রেললাইনে পড়ে থাকা সিপিএমের এক নির্বাচনী এজেন্টের রক্তাক্ত দেহ।

সল্টলেকের কেসি ব্লকের বাসিন্দা উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় (৩১) শনিবার কেবি কমিউনিটি সেন্টারে সিপিএমের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। অভিযোগ, ছাপ্পা ভোটের প্রতিবাদ করায় ভোটের দিনই তাঁকে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়। খুনের হুমকির মুখে ভোট শেষ হওয়ার অনেক আগেই বুথ ছেড়ে চলে যান উজ্জ্বল। স্থানীয় সিপিএমের অভিযোগ, বাড়ি চলে গেলেও ভোট শেষ হওয়ার পরে তৃণমূলের লোকেরা তাঁকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে এসে পোলিং এজেন্ট হিসেবে নির্দিষ্ট ফর্মে সই করিয়ে নেয়। তার পরেই রবিবার রাতে উজ্জ্বলের দেহ মেলে বিধাননগর ও কাঁকুড়গাছি স্টেশনের মাঝে রেললাইনের ধারে।

উজ্জ্বলের বাবা উদয়বাবুর অভিযোগ, তাঁর ছেলেকে খুন করা হয়েছে। উজ্জ্বলের কয়েক জন বন্ধুবান্ধবের অবশ্য ধারণা, অপমান করে বুথ থেকে বার করে দেওয়ায় সংবেদনশীল উজ্জ্বল মানসিক ভাবে আহত হয়েছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

উজ্জ্বলের বাড়ির লোকেদের দাবি, রবিবার সন্ধ্যায় দমদম ক্যান্টনমেন্টে নতুন কেনা ফ্ল্যাট থেকে সল্টলেকের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল উজ্জ্বলের। তখনই ওই ঘটনা ঘটে।

২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে পাতিপুকুর রেললাইনের ধারে একই ভাবে এক যুবকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তিনি রিজওয়ানুর রহমান। যে মৃত্যুকে ঘিরে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি।

বিধাননগর জিআরপি থানায় সোমবার বিকেলে কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের কর্মী, উদয়বাবুর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে রেল পুলিশ খুনের মামলা দায়ের করে তদন্তে নেমেছে। জিআরপি সূত্রের খবর, উদয়বাবু তাঁর লিখিত অভিযোগে দাবি করেছেন, তাঁর ছেলেকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। সংবাদমাধ্যমের কাছে এ দিন সকালে তিনি অভিযোগ করেন, উজ্জ্বলের মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখাতে জিআরপি তাঁকে চাপ দেয়। কিন্তু সেই চাপ তিনি মানেননি।

শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ উদয়বাবুর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘এমন কিছু আমার জানা নেই। মৃতের বাবা যখন খুনের লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন, তখনও তিনি আমাদের এমন কিছু জানাননি।’’ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রেরও অভিযোগ, পুলিশ এটাকে দুর্ঘটনা বলে চালাতে চাইছে। উজ্জ্বলকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে বলে রাজ্যপালের কাছে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন বাম নেতারা।

সোমবার বাম বিধায়কদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সূর্যবাবু বলেন, ‘‘বিধাননগরে পুরভোটের দিন আমাদের দলের এক প্রার্থীর এজেন্ট উজ্জ্বলকে মারধর করা হয়েছিল। জোর করে সই করানোরও চেষ্টা হয়েছিল। তার পরেই তার মৃতদেহ পাওয়া গেল রেললাইনে! আমাদের আশঙ্কা, তাকে খুন করা হয়েছে। আগের দিনের ঘটনা মাথায় রাখলে সে রকমই মনে হয়।’’ সূর্যবাবু জানান, রাজ্যপালকে তাঁরা বলেছেন, ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সাংবিধানিক এক্তিয়ারের মধ্যে যা করণীয়, তিনি যেন তা করেন।

তৃণমূলের মহাসচিব তথা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। কী ঘটেছে, প্রশাসন তদন্ত করে দেখুক। এই নিয়ে আমাদের কী বলার আছে? তবে তদন্তে যদি দেখা যায় সিপিএমের অভিযোগ মিথ্যা, তা হলে যাঁরা এমন অভিযোগ করেছেন তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত!’’

সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, উজ্জ্বলের শরীরের বাঁদিকে ভারী কোনও বস্তুর আঘাত রয়েছে। বাঁ হাতের হাড় সরে গিয়েছে কাঁধ থেকে। কনুইও ভেঙেছে। মাথার বাঁ-দিক ও পিছনে গুরুতর চোট রয়েছে। বাঁ চোখ প্রায় কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন ময়না তদন্তকারীরা। মাথায় গুরুতর চোটের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে। নাকের হাড়ে চিড় ধরেছে। চোয়ালও ফেটে গিয়েছে।

অবিবাহিত উজ্জ্বল জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অস্থায়ী কর্মী। শনিবার তিনি বিধাননগর পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী দিলীপ ভাদুড়ীর নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। সিপিএম সূত্রের খবর, ওই বুথে প্রথমে তাঁদের এজেন্ট ছিলেন অন্য এক জন। কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি তিনি টিঁকতে পারেননি।

সকাল আটটা নাগাদ দ্বিতীয় এজেন্ট হিসেবে বুথে ঢোকেন উজ্জ্বল। কেবি-কেসি এলাকায় সিপিএমের শাখা সম্পাদক শ্যামল ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘আধ ঘণ্টার মধ্যেই উজ্জ্বল আমাকে ফোনে বলে, ‘প্রচণ্ড চাপ এখানে। থাকা যা, না থাকাও তা!’’ সিপিএম প্রার্থী দিলীপ ভাদুড়ী জানান, সকাল সাড়ে ১০টায় উজ্জ্বল তাঁকেও ফোন করে একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি গিয়ে দেখি, বুথে প্রচুর বাইরের ছেলে। উজ্জ্বলকে বলে আসি, আমরা তোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারব না। পারলে থাকবি, না পারলে বেরিয়ে যাবি।’’

শ্যামলবাবু জানান, আড়াইটে পর্যন্ত বুথে ছিলেন উজ্জ্বল। তার পর বুথ থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে, পার্টির কয়েক জন নেতার সঙ্গে বসেছিলেন। পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফেরেন। শ্যামলবাবুর অভিযোগ, এর পরে উজ্জ্বলের বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যান তৃণমূলের কয়েক জন স্থানীয় কর্মী। পোলিং এজেন্ট হিসেবে নির্দিষ্ট ফর্মে সই করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। শ্যামলবাবু বলেন, ‘‘উজ্জ্বলের মতো আমাকেও জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ৩০-৪০ জন যুবকের দল। আমি উজ্জ্বলকে বলেছিলাম, চুপ করে সই করে দে। ও তাই-ই করেছিল।’’ যদিও ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস জানার জাবি, যাবতীয় অভিযোগ মিথ্যে। ‘‘ওই ধরনের কোনও ঘটনাই ঘটেনি’’, বলেছেন তিনি।

এ রকম মানসিক চাপে পড়ে কেউ কি আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন? মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলেন, ‘‘যে রকম হুমকির কথা বলা হচ্ছে, তাতে মারাত্মক ভয় পেয়ে থাকতে পারেন ওই যুবক। যেখান থেকে আত্মহত্যা করাটা অস্বাভাবিক নয়।’’

উজ্জ্বলের মা ইলাদেবী অবশ্য জানিয়েছেন, ভোট শেষে বাড়ি ফেরার পর থেকে উজ্জ্বলের ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিকতা তিনি দেখেননি। রবিবার সকালে যথারীতি আড্ডাও মারতে বেরিয়েছিলেন। দুপুরে স্নান-খাওয়া সেরে বাবার সঙ্গে দমদম ক্যান্টনমেন্টের নতুন কেনা ফ্ল্যাটে যান। কেসি-র ওই সরকারি আবাসন থেকে ফ্ল্যাটে জিনিসপত্র সরানোর কাজ চলছে। রবিবার ফ্ল্যাটে পৌঁছনোর কিছু পরে উদয়বাবু যখন ফিরতে চান, তখন উজ্জ্বল জানান, তিনি কেবল টিভি-র লোকের জন্য অপেক্ষা করবেন। বাড়ি ফিরবেন সাড়ে সাতটা নাগাদ। এ দিন ইলাদেবী বলেন, ‘‘সাড়ে আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরে আমরা বার বার ওর মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করি। দেখি মোবাইল বন্ধ করা রয়েছে।’’ পরে উজ্জ্বলের ঘড়ি, আংটি, মানিব্যাগ পাওয়া গেলেও তাঁর দু’টি মোবাইলের একটিও পাওয়া যায়নি।

উদয়বাবুর বক্তব্য, দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনে বিধাননগর স্টেশনে নেমে বাস ধরার কথা উজ্জ্বলের। কিন্তু বিধাননগর স্টেশন ছাড়িয়ে কাঁকুড়গাছির দিকে উজ্জ্বলের দেহ মিলল কী করে? বাড়ির লোকেদের সেটাই প্রশ্ন। উদয়বাবুর বক্তব্য, ওই দিকে উজ্জ্বলের যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না।

যেখানে উজ্জ্বলের দেহ মিলেছে, তার দূরত্ব বিধাননগর স্টেশন থেকে হেঁটে ১৫ মিনিট। ঘটনাস্থল লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় পৌঁছে বাস-অটোরিকশা পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি, রাত ১০টা নাগাদ তাঁরা ট্রেনে কিছু ধাক্কা লাগার শব্দ শোনেন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে বিধাননগর স্টেশনে খবর পাঠান। তাঁরা জানান, অনেক সময়ে ট্রেন সিগন্যালে থামলে কিছু যাত্রী ওখানে নেমে যান।

যদিও এ ক্ষেত্রে কোনও ট্রেনের চালক বা গার্ড কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে (নক ডাউন) বলে কোনও খবর কন্ট্রোলে পাঠাননি। যার জন্য পূর্ব রেলের কর্তারা বলতে পারেননি, ঠিক কোন ট্রেনে ধাক্কা লেগেছে। পূর্ব রেল সূত্রের খবর, বিধাননগর স্টেশনে পুলিশ রবিবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ খবর দেয়, তিন ও চার নম্বর লাইনের মধ্যে এক জন পড়ে আছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE