দেবু চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা স্টেশনে ট্রেনের কামরায় বসিয়ে বাবা ছেলেটিকে বলেছিল— ‘একটু বসো। আমি এক্ষুণি আসছি।’
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল বছর ছয়েকের ছেলেটি। চোখ মেলে দেখে, জোরে ট্রেন ছুটছে কোথাও। আশপাশে নেই বাবা। ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছিল সে। একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে পড়ে ছেলেটি। হতবাক হয়ে বসেছিল এক কোণে। গত রবিবার সন্ধেয় জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস কোডারমা স্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখতে পান রেলরক্ষীরা। আধো বাংলায় তার কথা কেউ বুঝতে পারেননি। তবে স্পষ্ট হয়, ছেলেটি পথ হারিয়েছে। খবর দেওয়া হয় স্থানীয় চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিকে। ওই সংস্থার আধিকারিক রাজকুমার সিনহা বলেন, ‘‘ওর কথা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। ডেকে নিয়ে আসা হয় সন্দীপ মুখোপাধ্যায় নামে আমাদের সংস্থার এক বাঙালি যুবককে। সন্দীপবাবুই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেন।’’
সন্দীপবাবু বলেন, ‘‘ছেলেটি খুবই সপ্রতিভ। নাম দেবু। ও জানিয়েছে, বাবার নাম কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগনার গুমায়।’’ তিনি জানান, দেবুর বাবার বারাসতের বামুনগাছিতে প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান রয়েছে। কিন্তু ছেলেটি বলেছে, সে আর বাড়ি ফিরতে চায় না। ওকে সবাই নাকি মারধর করে। কেন বাড়ি ফিরবে না দেবু? আধো গলায় ফোনের ও পার থেকে ছেলেটি বলে, ‘‘বাড়িতে নতুন মা এসেছে। বাবা, মা আমাকে খুব মারে। বাবাই আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে চলে গিয়েছে। আমি আর বাড়িতে ফিরব না।’’
কোডারমার রেল পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর নারদ গহেনত বলেন, ‘‘ছেলেটির কথাবার্তা শুনে, জামাকাপড় দেখে বোঝা যায় কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেন ওর বাবা এ ভাবে জম্মুর ট্রেনে তুলে দিল বুঝতে পারছি না। এতটা নিষ্ঠুরও কেউ হতে পারে!’’ তিনি আরও জানান, বারাসতে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের একটি দল কয়েক দিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে দেবুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান অরবিন্দ দাশগুপ্ত এ দিন বলেন, ‘‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। দু’এক দিনের মধ্যেই ঝাড়খণ্ড থেকে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট আসবে। তার পরেই উপযুক্ত পদক্ষেপ করব।’’ অরবিন্দবাবু জানিয়েছেন, ওই ছেলেটির পরিবার তাকে ফেরত নিতে চায় না। বাচ্চটিও ফিরতে চাইছে না বাড়িতে। দু’পক্ষকেই বোঝানোর চেষ্টা করা হবে। তাতেও সমস্যা না মিটলে ছেলেটিকে হোমে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। এতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।’’
সন্দীপবাবু জানান, দেবু খুব বুদ্ধিমান। প্রথমে সে জানিয়েছিল, ওর বাবার নাম কেষ্ট। পরে বলে, ‘কেষ্ট বাবার ডাকনাম। ভাল নাম দীপঙ্কর।’ সন্দীপবাবু বলেন, ‘‘গুগুল ম্যাপে গুমার একটি জামা মসজিদের উল্লেখ রয়েছে। দেবু জানিয়েছে, ওই মসজিদ সে চেনে। সম্ভবত তার আশপাশেই ওর বাড়ি।’’ রসগোল্লা খেতে ভালবাসে দেবু। সন্দীপবাবুরা প্রতি দিন তাকে সেই মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। মিলছে পছন্দের মুরগির মাংস, পোস্তও। সন্দীপবাবু বললেন, ‘‘এত সুন্দর ছেলে। কয়েক দিনের মধ্যেই ও আমাদের কাছের হয়ে গিয়েছে। গেলে খুব খারাপ লাগবে।’’
দেবু কিন্তু এখনও বলে চলেছে— ‘‘কিছুতেই ফিরব না। এই কাকুদের সঙ্গেই থাকব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy