Advertisement
০২ মে ২০২৪

পা এগিয়ে দিলেন রচপাল জুতো বাঁধলেন দেহরক্ষী

কারও জুতো হাতে করে এগিয়ে দেন দেহরক্ষী। কাউকে আবার জুতো পরিয়েও দিতে হয়। ‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারে পাদুকা পুরাণের কতই না রূপ! বছরখানেক আগে মহাকরণে এক মনীষীর ছবিতে মালা দেওয়ার পরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের জুতো নিজের হাতে তুলে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। সেই জুতোয় পা গলিয়ে করিডর বেয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিলেন তিনি।

সোমবার এই দৃশ্যেরই সাক্ষী থাকল নবান্ন। — নিজস্ব চিত্র

সোমবার এই দৃশ্যেরই সাক্ষী থাকল নবান্ন। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০৩:৫২
Share: Save:

কারও জুতো হাতে করে এগিয়ে দেন দেহরক্ষী। কাউকে আবার জুতো পরিয়েও দিতে হয়। ‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারে পাদুকা পুরাণের কতই না রূপ!
বছরখানেক আগে মহাকরণে এক মনীষীর ছবিতে মালা দেওয়ার পরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের জুতো নিজের হাতে তুলে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। সেই জুতোয় পা গলিয়ে করিডর বেয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিলেন তিনি।
সোমবার নবান্নে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে রাজ্যের পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী রচপাল সিংহ জুতো পরার জন্য পা এগিয়ে দিলেন দেহরক্ষীর সামনে। পুলিশকর্মী মাথা নিচু করে পালন করলেন মন্ত্রীর নীরব নির্দেশ।
রাজতন্ত্রে এবং জমিদারি আমলে এমনটা অবশ্য আকছার ঘটত। ‘বাবু’ খাজনা আদায়ে বেরোবেন কিংবা শিকারে, বাড়ির ভৃত্য নাগরা পরিয়ে দিচ্ছেন— চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে এই ছবি। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের কথায়, সাহেবদের হাত ফেরতা হয়ে এই সংস্কৃতি এক কালে প্রবেশ করেছিল ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের মধ্যেও।

কিন্তু গণতন্ত্রে এমনটা অনুমোদন করা চলে কি? তা ছাড়া সরকারি চাকরিরত পুলিশকর্মী তো ব্যক্তিগত ভৃত্য নন! তবে? সোমবার রচপাল সিংহের আচরণে বিতর্ক বেধেছে রাজনৈতিক শিবিরে।

এ দিন ছিল শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের জন্মদিন। সেই উপলক্ষে রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতরে বেইজের ছবিতে মালা দিতে এসেছিলেন রচপাল। বাতানুকূল অডিটরিয়ামে ফুল ও ধূপের গন্ধে তৈরি মনোময় পরিবেশে আচমকাই তাল কাটল। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কর্মীরা দেখলেন, মালা দেওয়ার পরে ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে যেখানে জুতো খুলেছিলেন সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন রচপাল। তাঁর সরকারি দেহরক্ষী নিচু হয়ে বসে পড়ে মন্ত্রীর এগিয়ে দেওয়া বাঁ পায়ে লাল-কালো জুতো পরিয়ে দিলেন।

কেন এমন প্রভুসুলভ আচরণ? পরে সাংবাদিকদের কাছে মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, তাঁর পিঠে ব্যথা ছিল। তিনি নিচু হতে পারছিলেন না। ‘‘ওষুধ খেয়ে এসেছিলাম আমি। আমার রক্ষী তা জানতেন। তাই জুতো পরতে সাহায্য করেছিলেন।’’ ওই রক্ষী এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি। তবে তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, এ দিনের ঘটনার পিছনে কারণ যা-ই হোক না কেন, মন্ত্রী-সান্ত্রীরা অনেক সময়েই সরকারি রক্ষীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আর্দালির মতো ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস নেই। নির্দেশ অমান্য করলে শুধু রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রান্তে বদলি হতেই হবে না, শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা। মেয়রের ভাইঝির প্রসঙ্গ তুলেই তাঁরা বলছেন, পুলিশের ‘রুল বুক’ মেনে ডিউটি করতে গিয়েই নাজেহাল হতে হল এক জন কনস্টেবলকে। এর পরে যদি মন্ত্রীদের নির্দেশ অমান্য করা হয়, তা হলে হয়তো চাকরিটাই খোয়াতে হবে!

সমাজতত্ত্ববিদ প্রদীপ বসু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ক্ষমতা প্রদর্শনের নিকৃষ্টতম উপায়গুলি এই ভাবেই সমাজে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে দু’পক্ষের নীরব সমঝোতার মধ্যে দিয়েই। যিনি যথেচ্ছাচার করেন আর যিনি যথেচ্ছাচার সয়ে যান, তাঁরা উভয়েই নিজের মতো করে বুঝে নেন লাভ-লোকসানের অঙ্ক।

তবে বিধানসভায় এ দিন রচপালের ঘটনাটি নিয়ে যথেষ্ট হইচই হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের বাজেট বিতর্ক চলাকালীন বাম বিধায়ক আনিসুর রহমান ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ তুলে বলেন, এক জন সিনিয়র মন্ত্রী সরকারি কর্মীকে দিয়ে নিজের জুতোর ফিতে বাঁধাচ্ছেন। টিভিতে সেটা দেখানো হচ্ছে। এ কী ভাবে সম্ভব?

আনিসুর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলতে থাকেন, এক জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আগে নোটিস দিতে হয়। সেটাই সংসদীয় নিয়ম। সে সব না মেনে বাজেট আলোচনার মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে নিয়ম ভঙ্গ করছেন বাম বিধায়ক। এ নিয়ে দু’পক্ষে কিছুটা চিৎকার চেঁচামেচি হয়। তবে বিধানসভার বাইরে শাসক দলের অনেক বিধায়কই রচপালের এই আচরণের নিন্দা করেন। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘তৃণমূল রাজ্য পরিচালনা করছে না। নবাবি কায়দায় বাংলাকে শাসন করছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে রচপালের আচরণে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE