Advertisement
১৯ মে ২০২৪

অফিসার দিয়ে মাছ-মেলার টাকা তোলার মাৎস্যন্যায়

হরেক মেলা-খেলায় দেদার খয়রাতি চলছে। সেটা তবু এক রকম। কিন্তু এ বার শুরু হয়েছে মাছ-মেলার স্মরণিকায় বিজ্ঞাপন আদায়ের নামে টাকা তোলার খেল্! এবং রীতিমতো সরকারি নির্দেশিকা জারি করেই সেই টাকা তোলার বন্দোবস্ত হয়েছে জেলা স্তরের অফিসারদের দিয়ে।

জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে বলে নির্দেশিকা।

জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে বলে নির্দেশিকা।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

হরেক মেলা-খেলায় দেদার খয়রাতি চলছে। সেটা তবু এক রকম। কিন্তু এ বার শুরু হয়েছে মাছ-মেলার স্মরণিকায় বিজ্ঞাপন আদায়ের নামে টাকা তোলার খেল্! এবং রীতিমতো সরকারি নির্দেশিকা জারি করেই সেই টাকা তোলার বন্দোবস্ত হয়েছে জেলা স্তরের অফিসারদের দিয়ে।

রাজ্যের মৎস্য দফতরের উদ্যোগে কাল, শুক্রবার থেকে ২০ ডিসেম্বর নলবনে মাছ উৎসব হচ্ছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেঙ্গল ফিশফেস্ট’। সেই মেলার খরচ তোলার জন্য স্মরণিকায় বিজ্ঞাপন সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ১৯টি জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাদের (এডিএফ)। সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে এ ভাবে বিজ্ঞাপনের টাকা আদায় নিয়ে বিতর্ক বেধেছে খাস মৎস্য দফতরেই।

ঠিক কী ঘটেছে?

মৎস্য দফতরের অধিকর্ত্রীর সই করা একটি নির্দেশিকা (মেমো নম্বর ১২২ (৬৪)-আইপিইউ/২০/০১/ ২০১৫) জারি করা হয়েছে ১৭ নভেম্বর। ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, মৎস্য মেলার উদ্বোধনের দিনে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। মাছের রকমারি বিষয় থাকবে তাতে। ওই স্মরণিকা প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপনের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে সব জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাদের। ন্যূনতম কত টাকা আদায় করতে হবে, নির্দেশিকায় তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাকে কম করে এক লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে হবে। শুধু স্মরণিকার বিজ্ঞাপন নয়, মেলায় স্টল বসাতে ‘স্পনসর’-এর হদিস দেওয়ার ভারও দেওয়া হয়েছে ওই সব সহ-মৎস্য অধিকর্তাকে।

এই নির্দেশ নিয়ে বিতর্ক কেন?

রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বে থাকা ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের বক্তব্য, কোনও সরকারি আধিকারিক বিজ্ঞাপন সংগ্রহের দায়িত্ব নিতে পারেন না। নির্দেশিকা জারি করে আধিকারিকদের বিজ্ঞাপনের টাকা তোলার দায়িত্ব দেওয়াটা অন্যায় বলেই মনে করছেন তাঁরা। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘সরকারি কোনও অনুষ্ঠান উপলক্ষে সরকারি আধিকারিক নিজের দফতরের বাজেট থেকে টাকা বরাদ্দ করতে পারেন। কিন্তু খাতায়-কলমে আধিকারিকদের বিজ্ঞাপন আদায় করতে বলার অর্থ দুর্নীতিতে মদত দেওয়া।’’

স্মরণিকা প্রকাশ উপলক্ষে বিজ্ঞাপন বাবদ সংগৃহীত অর্থের টাকার ব্যাঙ্ক-চেক জমা দেওয়ার পদ্ধতির বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন রাজ্যের সহ-মৎস্য অধিকর্তারা। নির্দেশিকা অনুযায়ী বিজ্ঞাপন বাবদ সংগৃহীত চেক মৎস্য উৎসবের সহযোগী আইসিসি (ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স)-র নামে কেটে তা পাঠাতে হবে রাজ্যের মৎস্য দফতরের ঠিকানায়। মৎস্য দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘চেক লেখা হচ্ছে এক নামে। আর সেটা পাঠানো হচ্ছে অন্য ঠিকানায়। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’’

জেলা সহ-মৎস্য অধিকর্তারা নির্দেশিকা কতটা মানছেন?

মৎস্য দফতর সূত্রের খবর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার সহ-মৎস্য অধিকর্তারা ইতিমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করে ফেলেছেন। তবে দক্ষিণবঙ্গেরই অন্য এক সহ-মৎস্য অধিকর্তার কথায়, ‘‘৫০ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছে। অনেককে বিজ্ঞাপন দিতে বলেও লাভ হয়নি।’’ বেশির ভাগ সহ-মৎস্য অধিকর্তাই মৎস্য দফতরের ওই নির্দেশিকায় ক্ষুব্ধ। তাঁদের কথায়, ‘‘এই প্রথম আমরা এমন অদ্ভুত একটি নির্দেশিকা পেলাম। সব কাজ ফেলে শুধু বিজ্ঞাপন সংগ্রহেই মন দিতে হচ্ছে।’’ এক সহ-মৎস্য অধিকর্তা তো এটাকে সরাসরি তোলাবাজির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘অফিসার হয়েও আমাদের তোলা আদায়কারীর ভূমিকায় নামতে হচ্ছে! এটা ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগছে।’’

এ-হেন নির্দেশিকা সম্পর্কে কী বলছেন অবসরপ্রাপ্ত আমলারা?

রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব অর্ধেন্দু সেন বলেন, ‘‘৪০ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় এমন নির্দেশিকা দেখিনি। এই ধরনের নির্দেশিকা জারি করা থেকে সরকারের বিরত থাকাই উচিত।’’ প্রাক্তন মুখ্যসচিব অশোকমোহন চক্রবর্তীরও মন্তব্য, ‘‘আমি ৩৬ বছর কাজ করেছি। কখনও নির্দেশিকা জারি করে অফিসারদের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে বলা হয়নি। এমন নির্দেশিকার কথা এই প্রথম শুনছি।’’

প্রাক্তন আইএএস অসীমকুমার বর্মণ পরিষ্কার জানাচ্ছেন, কখনওই নির্দেশিকা জারি করে সরকারি আধিকারিকদের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে বলা যায় না। প্রাক্তন আইএএস মীরা পাণ্ডেও বলেছেন, ‘‘এমন নির্দেশিকার কথা কখনও শুনিনি।’’ আর এক প্রাক্তন আইএএস বিক্রম সরকারের মন্তব্য, নির্দেশিকা জারি করে আধিকারিকদের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে বলাটা সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ। ৩৫ বছরের কার্যকালে এমন নির্দেশিকা তাঁর চোখে পড়েনি। ‘‘এই ধরনের নির্দেশিকা প্রত্যক্ষ ভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। কারণ, যাদের কাছে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা হবে, আগামী দিনে সেই সব বিজ্ঞাপনদাতা সংশ্লিষ্ট মৎস্য আধিকারিকদের কাছে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা চাইতেই পারেন,’’ বলছেন বিক্রমবাবু।

কী বলছেন রাজ্যের মৎস্য দফতরের কর্তারা?

রাজ্যের মৎস্য অধিকর্ত্রী মালবিকা ঝা বলেন, ‘‘আমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হয়নি। বৈঠকে একাধিক আধিকারিক ছিলেন। সকলের মত নিয়েই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে অন্যায়ের কিছু নেই।’’ এটা যে খারাপ ব্যাপার, প্রকারান্তরে সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন মৎস্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (সদর) শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। ওই নির্দেশিকার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে শৈলেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘আমাদের ভাল কাজগুলির উল্লেখ না-করে খারাপ বিষয়গুলি লিখছেন কেন?’’ অর্থাৎ তাঁর দাবি, তাঁরা ভাল কাজই করেন এবং এটা খারাপ কাজের একটা!!

কী বলেন মৎস্যমন্ত্রী?

‘‘মৎস্যমেলা উপলক্ষে জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তাদের করণীয় বিষয় নিয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে মাত্র। এই নির্দেশিকা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে,’’ বললেন মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। সরকার তার আধিকারিকদের নির্দেশ দিতেই পারে। কিন্তু নির্দেশিকা জারি করে তাঁদের বিজ্ঞাপন আদায় করতে বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

জবাব নেই মৎস্যমন্ত্রীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE