জনসভায় তাঁর কণ্ঠস্বর দলের কর্মী-সমর্থকেরা আর কতটুকু শুনতে পাবেন, সন্দেহ! আপাতত ছাপার অক্ষরেই নিজের কথা পৌঁছে দিতে মনোনিবেশ করেছেন তিনি।
সদ্যই পুজোর মুখে তাঁর ‘ফিরে দেখা’ বাজারে ‘হিট’ করেছে। পুজো শুরুর দেড় দিনের মধ্যেই মণ্ডপের বাইরে বুকস্টল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের গোড়ার পাঁচ বছরের কাহিনি! লেখক এ বার হাত দিয়েছেন তাঁর পরবর্তী পুস্তকে। এ বারের বিষয়? বিগত বামফ্রন্ট সরকারের শেষ ১০ বছর। অর্থাৎ তার মধ্যে অবধারিত ভাবে আছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের উপাখ্যান! যে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ দলের ভিতরে-বাইরে অজস্র সমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়ে তাঁকে প্রায় খলনায়ক বানিয়ে দিয়েছিল! কী করতে চেয়েছিলেন, কোথায় বাধা এসেছিল এবং শেষমেশ কী হয়েছিল— নিজের হাতে লিখছেন সেই সময়ের সরকারের কাণ্ডারী।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামই ২০১১ সালে পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে ফেলেছিল রাজ্যপাটে। বামফ্রন্ট সরকারের বিদায়ের পরেও নানা স্তরে অবিরাম কাটাছেঁড়া চলেছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে। নানা মহল থেকে আঙুল উঠেছে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই। আর পরিবর্তিত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে-ময়দানের রাজনীতি থেকে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছেন ‘অভিযুক্ত’! কিছু দিন আগে দলের তরফে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের পর্যালোচনা রিপোর্টে অবশ্য সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসাবেই উল্লেখ করেছেন তিনি। তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, বামফ্রন্টের শেষ কয়েক বছরে রাজ্য জু়ড়ে বহু একর জমি নেওয়া হয়েছে বিনা গোলমালে। সমস্যা হয়েছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামেই। এ বার লেখকের উদ্দেশ্য, পূর্ণাঙ্গ ভাবে বামফ্রন্টের শেষ ১০ বছরের জমানার নীতি ও কাজের বিশ্লেষণ করা। যে সময় মহাকরণে কর্ণধারের ভূমিকায় ছিলেন স্বয়ং লেখকই!
লেখকের কথায়, ‘‘একটা বড় কাজে হাত দিচ্ছি। বামফ্রন্টের শেষ ১০টা বছর ফিরে দেখতে চাই।’’ দলের নানা আলোচনা, কিছু নথি এবং নিজের স্মৃতিই আপাতত ভরসা। যে সময়ের উপাখ্যান লিখছেন, সেই পর্বে নিয়মিত তাঁকে নানা সভায় বলতে শোনা যেত, ‘‘হাজার হাজার ছেলেমেয়ে তাকিয়ে আছে। শিল্পের দিকে আমাদের এগোতেই হবে।’’ এখনও বলছেন, ‘‘ইস্পাত, অটো-মোবাইল, পেট্রোকেমিক্যাল্স— এই শিল্পগুলোকে আমরা ধরতে চেয়েছিলাম। রাজ্যে বিনিয়োগ টেনে কর্মসংস্থান করতে গেলে এগুলোই সব চেয়ে উপযোগী ছিল। আর এখন তো শুনে যেতে হচ্ছে তেলেভাজা শিল্প, মুড়িভাজা শিল্প!’’
জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে ১৯৯৪ সালে বামফ্রন্ট সরকার যে শিল্প নীতি নিয়েছিল, তার কথা ৩৪ বছরের পর্যালোচনা রিপোর্টেই বলা হয়েছিল। সঠিক পরিপ্রেক্ষিতকে ব্যাখ্যা করার জন্য নয়ের দশকের শেষ দিকের পরিস্থিতি, শিল্প ও বাণিজ্যের তদানীন্তন ধারার কথা আবার এসে পড়বে এই নতুন বইয়েও। সেখান থেকে আলোচনা ঢুকে পড়বে টাটার গাড়ি কারখানা, জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্প বা পূর্ব মেদিনীপুরে রাসায়নিক শিল্প-তালুকের প্রস্তাবের প্রসঙ্গে। শুভানুধ্যায়ীরা বহু দিন ধরেই বলে আসছিলেন, তৎকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে তিনি তো রাজ্যের জন্য ভাল উদ্যোগেই ব্রতী হয়েছিলেন! ভাবনা এবং উদ্দেশ্যে কোনও খাদ ছিল না। গোলমাল হয়েছিল পরিকল্পনা রূপায়ণে। সাদা-কালোয় কেন তা হলে তিনি নিজের সময়ের গোটা ঘটনাপ্রবাহ নিজের দিক থেকে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন না! শেষ পর্যন্ত দল এবং লেখকের মনে হয়েছে, সেটাই করা উচিত।
অজস্র বই, নানা নথিপত্র পড়ে কলম চালানোতেই অবশ্য নিজেকে এখন বেশি স্বচ্ছন্দ মনে হচ্ছে লেখকের। বহু দিন পরে চার দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে যাদবপুরে একটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন। সে দিনও দেখা গিয়েছে, দলের নিচু তলায় এখনও তাঁর বিপুল চাহিদা! মুখ হিসাবে যে তাঁর বিকল্প উঠে আসেনি, দলে সতীর্থেরাও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেন। কিন্তু এ সবেও তিনি ভুলছেন না! নতুনদের জায়গা করে দিয়ে ধীরে ধীরে অন্তরালে চলে যাওয়ার নীতিতে তিনি অনড়! লক্ষ্যে পৌঁছতে চান বলে অনুরোধ পেলেও মাইক ধরে বক্তৃতা করতে এখন আর সহজে রাজি হন না। শরীরের অন্তরায় তো আছেই। ন’মাস আগে ব্রিগে়ড সমাবেশে বক্তা তালিকা থেকে সরে এসে সভাপতিত্ব করেছিলেন। আবার ব্রিগেড আসন্ন। মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করার বাসনা এ বারও তাঁর নেই।
প্রাথমিক ভাবে অসুবিধা হোক, হোঁচট খেতে হোক, তবু সংগঠনের ভার উত্তরসূরিদের হাতে দিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু অনেকে তো তাঁর কথা শুনতে চায়? ‘‘আবার বিসমিল্লায় গিয়ে আরম্ভ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়! আমি চন্দ্রবাবু নায়ডু নই, লালুপ্রসাদও নই। আমি জানি কোথায় দাঁড়ি টানতে হয়!’’ দল ও ঘনিষ্ঠ মহলে বলে রাখছেন তিনি।
শুধু দাঁড়ি টানার আগে নিজের যা বলার, বইয়ের অক্ষরেই বলে যাবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy