Advertisement
১০ মে ২০২৪

অনেক মায়ের আদরে বুড়ির ঘরবাড়ি এখন হাসপাতাল

জন্মদাত্রী কে, জানা নেই আট বছরের মেয়েটির। জানার বিশেষ প্রয়োজনও মনে করেনি। কারণ, সে পেয়েছে অনেক ‘মা’।

হাসপাতালে ‘মায়েদের’ মাঝে বুড়ি। —নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালে ‘মায়েদের’ মাঝে বুড়ি। —নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:২৭
Share: Save:

জন্মদাত্রী কে, জানা নেই আট বছরের মেয়েটির। জানার বিশেষ প্রয়োজনও মনে করেনি। কারণ, সে পেয়েছে অনেক ‘মা’।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের দরজার পাশেই রয়েছে একটি বিছানা। ছোট্ট মেয়েটিকে সব সময় দেখা যায় সেখানে। কাজের ফাঁকে ডাক্তার-নার্স-আয়াদের কারও না কারও চোখ ঘোরাফেরা করে তার উপরে। কেউ ডাকেন ‘বুড়ি’, কেউ ডাকেন ‘মৌ’। কখনও কোনও নার্স খাইয়ে দিচ্ছেন, কখনও আবার কোনও আয়া ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার মাঝে এসে খানিক খুনসুটি করে যাচ্ছেন।

কী ভাবে সে এখানে এল, তা হাসপাতালের কেউ বলতে পারেন না। নথিও নেই। তবে হাসপাতাল সূত্রের দাবি, মাস দু’য়েক বয়স থেকে এই হাসপাতালই ঠিকানা ‘বুড়ি’র। গোড়া থেকেই কোলের অভাব হয়নি তার। হাসপাতালের নার্সেরাই তুলে নেন দায়িত্বভার। জন্মের পর থেকেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছে বাচ্চাটা। শিরদাঁড়া ও স্নায়ুর সমস্যায় বুড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি, হাঁটতে-চলতেও পারে না। ডাক্তারেরা জানান, এক সময়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ ছিল। চিকিৎসার পাশাপাশি দিনরাত এক করে নার্সদের যত্ন সুস্থ করে তোলে তাকে।

গোড়ায় যে নার্সেরা ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই এখন অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হাসি মুখেই ‘বুড়ি’র দেখভালের ব্যাটন তুলে নিয়েছে পরের প্রজন্ম। শিশু বিভাগের নার্স মৌসুমি রায়, সুমনা লায়েকরা বলেন, “সিনিয়রেরা বুড়িকে মাতৃস্নেহে পালন করতেন। আমরাও সে ভাবেই ওকে আগলেছি।” তাঁদের সবাইকে ‘মা’ বলে ডাকে ‘বুড়ি’।

প্রায় সাড়ে চার বছর আগে বর্ধমান থেকে কল্যাণীতে বদলি হন নার্স ঝর্না ঘোষ। পরে অবসর নিয়েছেন। এখনও নিয়মিত বুড়ির খোঁজ নেন। প্রতি মাসে খরচের জন্য কিছু টাকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। তাঁর কথায়, “মেয়েকে দেখা তো মায়েরই কর্তব্য।’’ সম্প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘বুড়ি’র দেখাশোনার জন্য দু’জন মহিলাকে রেখেছেন। রোগী কল্যাণ সমিতি এবং ডাক্তার-নার্সেরা সবাই মিলে খরচ দেন। ওই মহিলাদের এক জন মায়া পণ্ডিত বলেন, “বুড়ি দুল পরতে পছন্দ করে। ঝর্নাদি সোনার দুল দিয়েছেন। আরও অনেকেই নানা জিনিস দেন।”

নার্সদের আদরে থাকলেও ‘বুড়ি’কে নিয়ে চিন্তায় হাসপাতালের সুপার উৎপল দাঁ। তিনি বলেন, “হাঁটাচলা করতে না পারলেও বুড়ির আর কোনও অসুখ নেই। তাই এ ভাবে রোগীর ভিড়ে ওকে রাখা ঠিক নয়। খোলামেলা পরিবেশে বাড়তে দিতে হবে। পুনর্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসন ও শিশুকল্যাণ দফতরকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।” হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বারবার বলার পরে কয়েকটি হোমের লোকজন বুড়িকে দেখে যায়। কিন্তু ব্যবস্থা হয়নি। জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির সভাপতি দেবাশিস নাগ বলেন, “জেলায় বা বাইরের কোনও হোমে ওই শিশুকে রাখার মতো পরিকাঠামো নেই।” তবে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের আশ্বাস, “এ বার আমি নিজে উদ্যোগী হব।”

‘বুড়ি’র অবশ্য এ সবে হেলদোল নেই। একগাল হেসে সে বলে, ‘‘এখানে আমার অনেক মা। আমি এখানেই থাকব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nurse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE