মিলছে কই! হাটে-বাজারে সর্বত্রই। সস্তায় পুষ্টিকর। দেশি নয়, ভিয়েত কই।
এমনিতে আমবাঙালি তেল কই খাওয়া তো ভুলেইছে, ছোট কইও কিনতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগে। ৪০০-৫০০ টাকা কেজির নীচে তার দর যায় না। ১৫০-২০০ গ্রামের দেশি কইয়ের দাম কমপক্ষে ৮০০-৯০০ টাকা কেজি ওঠে। ফলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ভিয়েত কই-ই এখন বাঙালির হেঁসেলে শোভা পাচ্ছে। হাল্কা কালো থেকে ধূসর রঙ। এক-একটার ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম। ৩০০-৩৫০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
ক্যানিং বাজারের আড়তদার সঞ্জয় বিশ্বাস বললেন, ‘‘কলকাতার বাজারে ভিয়েত কইয়ের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। খুচরো বাজারে ৩০০-৩৫০ টাকা কেজিতে বড় কই বিক্রি হচ্ছে। ফলে মানুষ দেদার কিনছে।’’ খাদ্যরসিকরা বলছেন, ভিয়েত কই-তে বেশ নরম পুরু মাস। ঝাল-ঝাল কালিয়া দিব্যি ভাল। কিন্তু মাছের নিজস্ব স্বাদ-গন্ধ যদি বিচার্য হয়, তা হলে অবশ্যই এগিয়ে দেশি কই।
ভিয়েত কই কি ভিয়েতনামের মাছ? কেউ বলেন হ্যাঁ, কেউ বলেন না। কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থার মুখ্য বৈজ্ঞানিক বিজয়কালী মহাপাত্রর মতে, ‘‘এই কইয়ের পূর্বপুরুষদের বাস ভিয়েতনামেই। তবে দেশি কইয়ের সঙ্গে ভিয়েত কইয়ের অনেক মিলও আছে।’’ আবার ব্যারাকপুর মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের মৎস্যবিজ্ঞানী অর্চনকান্তি দাসের দাবি, এই কই এক সময় গঙ্গায় পাওয়া যেত। বিভিন্ন বইয়ে তার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মাছটি হারিয়ে যায়। তিনি বলছেন, ভিয়েত কই যাকে বলা হচ্ছে তা আসলে ‘অ্যানাবাস কোবোজিয়াস’। দেশি কই বা ‘অ্যানাবাস টেস্টুডিনিয়াস’-এরই অন্য একটি প্রজাতি।
রাজ্য মৎস্য দফতরে যুগ্ম অধিকর্তা শৈলেন্দ্র বিশ্বাসও বলছেন, এই কই একেবারেই দেশীয় মাছ। তা হলে এর নাম ভিয়েত কই কেন? নিমপীঠ রামকৃষ্ণ আশ্রম কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মৎস্যবিজ্ঞানী প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এই কই মাছের আদি নিবাস কোথায় তা নিয়ে আসলে ধন্দ রয়েছে।’’ বাংলাদেশেও গত তিন-চার বছর ধরে ব্যাপক হারে ভিয়েত কই চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলায় এখন ভিয়েত কই ছাড়া অন্য মাছ বড় একটা চাষই হচ্ছে না। ফলে অনেকে এমনও মনে করছেন, বাংলাদেশ ঘুরেই ভিয়েত কই পশ্চিমবঙ্গে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু লোকমুখে এখন ভিয়েত কই নামটাই হইহই করে ফিরছে।
দেশি কইয়ের ও ভিয়েত কইয়ের মধ্যে চরিত্রগত বেশি ফারাক নেই। কিন্তু ভিয়েত কই অল্প সময়ের মধ্যে ওজনে দ্রুত বাড়ে বলে চাষি ভাল দাম পান। উল্টো দিকে, দেশি কই বরং কম পাওয়া যায় এখন। যদিও বাংলার মাছের ঐতিহ্য কইয়ে পরিপূর্ণ ছিল। গবেষক হরিপদ ভৌমিক জানাচ্ছেন, কই মাছের নাম দিয়ে সব থেকে বেশি গ্রাম রয়েছে বাংলায়। কইকালা, কইখালি, কইগ্যাড়া, কইগ্রাম, কইচর, কইঝুরি নামে প্রায় ৪৯টি গ্রামের নাম পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ ওই সমস্ত গ্রামগুলি আগে কই মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৮১২ সালে ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়াম কেরির বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত ছড়াটিতেও কই মাছের কথা আছে। কিন্তু এখন শীতকাল ছাড়া ভাল সাইজের দেশি কইয়ের দেখা মেলাই দুষ্কর। সেই সুযোগে জাঁকিয়ে বসেছে ভিয়েত কই। মাস চারেকের মধ্যেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে তারা। অনেকেই অন্য মাছের চাষ ছেড়ে ভিয়েত কইয়ের চাষে নামছেন।
ভিয়েত কই চাষ করে স্বচ্ছলতা এসেছে বাসন্তীর কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামের মৎস্যচাষি সইফুল্লা বৈদ্যর। বছর দুয়েক আগে ছোট দু’টো পুকুরে ভিয়েত কই চাষ করেছিলেন। এই চাষে কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁরা। বারুইপুরের নেপালগঞ্জ থেকে ভিয়েত কইয়ের মীন নিয়ে এসে পুকুরে ছেড়েছিলেন। যা খরচ হয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই বেশি দামে সইফুল্লা ওই কই পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। সইফুল্লাই জানাচ্ছেন, এ বছর তাঁদের পারিবারিক জমিতে আরও দু’টো দুই বিঘা পুকুর কেটে কইয়ের চাষ শুরু করেছেন। সইফুল্লাকে দেখে বাসন্তীর অনেক চাষিই ভিয়েত কই চাষ করছেন। সইফুল্লার কথায়, ভিয়েত কই একবার চাষ করলে নেশা লেগে যায়।
বাসন্তীর চড়াবিদ্যার বাসিন্দা খল্লিল মোল্লাও মাস তিনেক হল এক বিঘা পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেছেন। ভিয়েত কই চাষ বেশ লাভজনক বলে জানাচ্ছেন তিনিও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিরাই জানাচ্ছেন, ঠিকমতো খাবার আর যত্ন পেলে ভিয়েত কই তিন-চার মাসের মধ্যে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। আরও বেশি দিন রাখলে ৪০০-৫০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলার মানুষ যেহেতু ছোট কই খেতে অভ্যস্ত, তাই ১০০-১৫০ গ্রামের মধ্যেই তাদের ওজন রাখা হচ্ছে। এক চাষি বলেন, ‘‘বারুইপুরের নেপালগঞ্জে এখন ভিয়েত কইয়ের সব থেকে বেশি মীন পাওয়া যাচ্ছে।’’
শৈলেন্দ্রবাবু বললেন, ‘‘দেশীয় পদ্ধতিতে এই মাছের মীন তৈরি করা হচ্ছে। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অধীনে তমলুকে মীন চাষ করা হচ্ছে।’’
উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ, বর্ধমানের মতো জেলাতেও ভিয়েত কইয়ের চাষে এখন বিপুল উৎসাহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy