হিন্দ মোটর, শালিমারের পরে জঙ্গপানা। এ রাজ্যে তালা ঝোলানো শিল্প সংস্থার তালিকায় নবতম সংযোজন। দার্জিলিঙের ১১৫ বছরের পুরনো চা-বাগানে বৃহস্পতিবার অনির্দিষ্ট কালের কর্মবিরতির নোটিস লটকে দেওয়াটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, এই সংস্থার গায়ে রুগ্ণ তকমা তো পড়েইনি, বরং তার চায়ের খ্যাতি বিশ্বজোড়া!
জঙ্গপানায় কাজ বন্ধের পিছনে অভিযোগের আঙুল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শ্রমিক সংগঠনের দিকে। চা-বাগান কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এক জন কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের নেতারা বেশ কিছু দিন ধরেই চাপ সৃষ্টি করছিলেন এবং আধিকারিকদের হুমকি দিচ্ছিলেন। বাগানের কাজেরও ক্ষতি করছিলেন তাঁরা। সমস্যা মেটাতে বুধবার কর্তৃপক্ষের তরফে যে বৈঠক ডাকা হয়, তাতেও আসেননি ইউনিয়নের নেতারা। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে বাগান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
মোর্চা সমর্থিত দার্জিলিং তরাই ডুয়ার্স প্লান্টেশন লেবার ইউনিয়নই জঙ্গপানা চা-বাগানের একমাত্র শ্রমিক সংগঠন। তবে ‘বহিরাগত এক কর্মীকে নিয়োগের প্রতিবাদে আন্দোলন’ করার সময় ইউনিয়ন নেতারা তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতাদের কথাও শুনছেন না বলে অভিযোগ। মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গ অবশ্য বৃহস্পতিবারই সন্ধ্যায় স্থানীয় বাসিন্দা এবং ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে অবিলম্বে বাগান খোলার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাগান খুলতে হবে। ইউনিয়নের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা হবে তার পরে।
সমতলে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট বা তোলাবাজির যে অভিযোগ বারবার উঠছে, পাহাড়ে সেই একই অভিযোগ উঠছে মোর্চার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন চা-বাগান মালিক সংগঠনের অভিযোগ, মোর্চা প্রভাবিত সংগঠনের সদস্য না-হলে কাউকে কাজে নেওয়া যাবে না বলে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। জঙ্গপানা কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি এক জনকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই লিখিত ভাবে এবং ফোনে হুমকি দেওয়া শুরু হয়। গত ১৮, ১৯ জুলাই কাজও হয়নি বাগানে।
বাগান মালিক শান্তনু কেজরিওয়াল বৃহস্পতিবার বলেন, “এই আন্দোলন সম্পূর্ণ বেআইনি। ইউনিয়ন যে সব দাবি করছে তা-ও বেআইনি।” বহিরাগতকে কাজ দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন হলেও তাতে যোগ দিতে অনেক বহিরাগত বাগানে আসছে বলেও শান্তনুবাবুর অভিযোগ।
দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশনের মুখ উপদেষ্টা সন্দীপ মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “বাগান পরিচালনায় ইউনিয়নের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। কর্তৃপক্ষকে সুষ্ঠু ভাবে বাগান পরিচালনা করতে দিতে হবে।”
এই সব অভিযোগই অস্বীকার করে শ্রমিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুরজ সুব্বা অবশ্য দাবি করেন, “কোনও হুমকি বা চাপ দেওয়া হয়নি। বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকদের বঞ্চিত করে এক জন বহিরাগতকে কর্মী নিয়োগে আপত্তি জানানো হয়েছিল মাত্র। সংগঠনের প্যাডে কোনও চিঠিও দেওয়া হয়নি।”
কার্যকারণ যা-ই হোক, তার জেরে ১১৫ বছরে এই প্রথম বন্ধ হল জঙ্গপানা চা-বাগান। যে বাগানের চায়ের কদর ব্রিটেন-ফ্রান্সে বিস্তর। বস্তুত, লন্ডনের বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ফোর্টনাম অ্যান্ড ম্যাসন, বা হ্যারডসের চায়ের তালিকায় অগ্রগণ্য জঙ্গপানাই। দেশের বাজারে তার দেখা প্রায় মেলে না বললেই চলে। সুতরাং জঙ্গপানায় তালা পড়ার অর্থ বিদেশি মুদ্রার আমদানিও কমে যাওয়া।
চা-বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলেন, দার্জিলিং চায়ে সেরার শিরোপার লড়াইটা মূলত গুডরিকের কাসলটন আর কেজরিওয়ালদের জঙ্গপানা বাগানের মধ্যে। ১৮৬৫ সালে চার্লস গ্রাহামের হাতে গড়ে ওঠা কাসলটন যদি ধ্রুপদী শিল্পী হয়, ৩৪ বছর পরে হেনরি মন্টোগোমারি লেনক্সের পত্তন করা জঙ্গপানা তা হলে আধুনিক বিস্ময়। স্বাদ আর গন্ধের নিরিখে জঙ্গপানা ইদানীং কাসলটনকেও কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বলেই অভিমত অভিজ্ঞ টি-টেস্টারদের। তবে মকাইবাড়ি, হ্যাপি ভ্যালি বা থুরবোকেও তালিকার বাইরে রাখতে নারাজ অনেকে।
জনশ্রুতি বলে, বহু বছর আগে এক ব্রিটিশ শিকারি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দার্জিলিং হিমালয়ের গহন জঙ্গলে। সঙ্গে গোর্খা পরিচারক জঙ্গ বাহাদুর। আচমকাই একটি বাঘ আক্রমণ করে জনশ্রুতি বলে, বহু বছর আগে এক ব্রিটিশ শিকারি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দার্জিলিং হিমালয়ের গহন জঙ্গলে। সঙ্গে গোর্খা পরিচারক জঙ্গ বাহাদুর। আচমকাই একটি বাঘ আক্রমণ করে ওই শিকারিকে। নিজের জীবন তুচ্ছ করে মনিবকে বাঁচান জঙ্গ বাহাদুর। গুরুতর আহত হয়ে মনিবের কাছে ‘পানা’ (জল) চেয়েছিলেন তিনি। কাছের একটি ঝরনা থেকে তাঁকে জল খাওয়ান ওই শিকারি। জঙ্গ বাহাদুর বাঁচেননি। কিন্তু ওই ঝোরা আর তার আশপাশের এলাকায় থেকে গিয়েছে তাঁর নাম।
এর বেশ কিছু বছর পরে জঙ্গপানায় প্রথম চা গাছটি পুঁতেছিলেন লেনক্স। অনতিবিলম্বে সেটি চলে আসে আর এক ব্রিটিশ জি ডব্লিউ ও’ব্রায়েনের হাতে। তার পর নেপালের তৎকালীন শাসক রানা পরিবারের হাত ঘুরে ১৯৫৬ সালে বাগানের মালিকানা যায় কেজরিওয়ালদের দখলে। তার পর ধীরে ধীরে চায়ের বাজারে প্রথম সারিতে উঠে এসেছে জঙ্গপানা। এখন তার কদর এতটাই যে, আর পাঁচটা সাধারণ বাগানের মতো নিলামের পথ ধরে দেশের পাইকারি বাজারে বলতে গেলে আসেই না সে।
জঙ্গপানার সেরা চা সরাসরি চলে যায় রফতানি সংস্থার হাতে। সেই চায়ের দাম কত, তা স্পষ্ট করে বলার উপায় নেই। তবে ওয়াকিবহাল মহল জানাচ্ছে, বেশ কয়েক হাজার টাকা কেজি দরে হাত বদল হয়ে জঙ্গপানার চা পাড়ি দেয় বিলেতে। এ দেশের বাজারে জঙ্গপানার যে চা নিলাম হয়, তা অপেক্ষাকৃত নিচু মানের আর পরিমাণেও কম। তবু বুধবারই কলকাতার নিলাম কেন্দ্রে ওই বাগানের যে ১১টি লট চা বিক্রি হয়েছে তার একটি লটের দাম উঠেছে কেজি-পিছু ১৮৬০ টাকা। স্বাভাবিক ভাবেই খুচরো বাজারে আসার সময় তার দাম আরও অনেকটাই চড়বে।
বছরের প্রথম বার তোলা পাতা (ফার্স্ট ফ্লাশ) না দ্বিতীয় বার তোলা পাতা (সেকেন্ড ফ্লাশ) কোন চা সেরা, তা নিয়ে চা-মহলে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সবটাই নির্ভর করে আবহাওয়ার উপরে।
তবে দুই মরসুমের চায়ের স্বাদ-গন্ধ আলাদা। ফার্স্ট ফ্লাশের লিকার হাল্কা সোনালি, অল্প ঝাঁঝাল আর মিঠে সুগন্ধে ভরা। সেকেন্ড ফ্লাশে লিকারের রং হয়ে যায় গাঢ় সোনালি। স্বাদ-গন্ধও আরও তীব্র।
সেকেন্ড ফ্লাশের মরসুম পেরিয়ে গেলেও বর্ষা এবং শরতেও জঙ্গপানায় বেশ ভাল চা হয় বলে খবর। ফলে এই সময় বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ভালই ধাক্কা। বিশেষ করে পুজোর আগেই যখন দেশের বাজারে টি-ব্যাগ চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন সে সব তো অনিশ্চিত করে দিলই। আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল এ রাজ্যের শিল্প-ভাগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy