রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকারের প্রশ্নে শিক্ষামহলের বড় অংশ এমনিতেই সন্দিহান। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে রীতিমতো বিতর্কের ঝড় বয়েছে। এ বার সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে সুগত মারজিত জানিয়ে দিলেন, তাঁর নিয়োগটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপের সামিল! নিজেকে সরকারের আস্থাভাজন হিসেবেও তিনি দাবি করেছেন, যা শুনে শিক্ষাবিদদের একাংশ মুখর হয়েছেন সমালোচনায়।
এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন যিনি, সেই সুরঞ্জন দাস যাদবপুরের উপাচার্য হয়েছেন। অর্থনীতির শিক্ষক সুগতবাবুকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য পদে বসানো হয়েছে। আগামী ছ’মাস তাঁর এই দায়িত্ব সামলানোর কথা।
এবং বুধবার নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেই সুগতবাবু নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সুগতবাবুর বক্তব্য: তিনি অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, সার্চ কমিটি মারফত আসেননি। তাই তিনি যে সরকারের পছন্দের লোক হবেন, এটাই স্বাভাবিক, কেননা তাঁর নিয়োগের পিছনে সরকারেরই ভূমিকা রয়েছে। ‘‘আমি সরকারের পছন্দের লোক। অপছন্দের লোক হলে সরকার অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে আমাকে নিয়োগ করত না।’’— এ দিন উপাচার্যের চেয়ারে বসে মন্তব্য করেন সুগতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আমার নিয়োগের মাধ্যমেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ হয়ে গিয়েছে!’’
প্রসঙ্গত, সরকারের ‘আস্থাভাজন’ হওয়ার সুবাদেই সুগতবাবুকে উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। পদটি তিনি ছাড়লেন কেন জানতে চাইলে ওঁর জবাব, ‘‘সময় পাচ্ছিলাম না বলে ছেড়ে দিয়েছি।’’ যদিও শিক্ষা দফতরের ইঙ্গিত, রাজ্য সরকারের মতভেদের জেরেই তিনি পদ ছেড়েছিলেন। নতুন কাজের পিছনে সময় দিতে পারবেন তো?
সুগতবাবু বলেন, ‘‘অসুবিধে হবে না। এ তো অস্থায়ী দায়িত্ব।’’ শিক্ষামন্ত্রী যখন-তখন ফোন করে ডাকলে কথা বলতে যাবেন?
অস্থায়ী উপাচার্যের মতে, সেটা না করার কারণ নেই। ‘‘শিক্ষামন্ত্রী আমাকে ফোন করে দেখা করতে বললে আমি কথা বলতেই পারি। তাঁর সঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার ভঙ্গ হবে না।’’— বলছেন তিনি। শিক্ষা দফতর জানিয়েছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অফিসার সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে তারা তদন্ত করবে, যে ঘোষণাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে শিক্ষাজগতের বড় অংশ। নবনিযুক্ত অস্থায়ী উপাচার্য কী ভাবে দেখছেন?
সুগতবাবুর দাবি, আর্থিক দুর্নীতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না-নিলে সরকার তার প্রশ্ন তুলতেই পারে। এ বিষয়ে সিএজি তদন্ত করতে পারে কিনা জানতে চাইলে ওঁর উত্তর, ‘‘অবশ্যই পারে।’’ তবে সরকারের ঘনঘন হস্তক্ষেপ যে তাঁর না-পসন্দ, অস্থায়ী উপাচার্য তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘সমস্ত কিছুতেই সরকারের উপদেশ আমার পছন্দ না-ও হতে পারে।’’
এ বার আসে ১ জুলাইয়ের হামলা-প্রসঙ্গ। সে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপরে বহিরাগতেরা এসে চড়াও হয়েছিল বলে অভিযোগ। ঘটনাটি ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে, এবং আঙুল উঠেছে শাসকদল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের দিকে।
ওই সময়ে চেয়ারে থাকলে সুগতবাবু কী করতেন?
অস্থায়ী উপাচার্যের পরিষ্কার জবাব, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতেরা গোলমাল পাকালে আমি পুলিশ ডাকতাম।’’ শিক্ষামন্ত্রীকে রিপোর্ট দিতেন কিনা, সে প্রশ্নও করা হয়। সুগতবাবুর মুখে অবশ্য নেতিবাচক উত্তর মিলেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে রিপোর্ট তলব করতে হলে আচার্য করবেন। কারণ, তিনি আমার নিয়োগকর্তা। সরকার বা শিক্ষামন্ত্রী নন। শিক্ষামন্ত্রী ডাকলে আমি কথা বলতেই পারি। কিন্তু রিপোর্ট দেওয়ার হলে আচার্যকেই দেব।’’
পাশাপাশি তিনি এ-ও আভাস দিয়ে রেখেছেন যে, অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘরোয়া গন্ডগোল নিজেই মেটাবেন। ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন সমস্যা উপাচার্য নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সমাধান করবেন। বাইরের সাহায্য নিতে হলে সে দিনই পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত।’’— পর্যবেক্ষণ সুগতবাবুর। এবং তাঁর ঘোষণা, ‘‘আমিই নিজেই এই সব সমস্যা মিটিয়ে দিতে পারব। সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে দেব না।’ বস্তুত তাঁর অভিমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কী করবেন, সেটা সরকারের তরফে বলে দেওয়ার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই।
কিন্তু এই সুগতবাবুই এ দিন পদে যোগ দিয়ে যে ভাবে নিজেকে সরকারের ‘পছন্দের লোক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তাতে নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষক সংগঠন কুটা এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া এড়ালেও শিক্ষাবিদদের একাংশ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুর বক্তব্য, ‘‘আত্মসম্মান রয়েছে, এমন কেউ এ কথা কী ভাবে বললেন, বুঝতে পারছি না। মোটেই উপাচার্যসুলভ মন্তব্য নয়।’’ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দলতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে কোনও উপাচার্য কর্তব্য পালন করতে পারেন না। আমরা হতবাক।’’ রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ‘‘কোনও রাখঢাক না-রেখে স্পষ্ট কথা বলার জন্যে ওঁর প্রশংসা করি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভাল না খারাপ, কিছু দিন পরে বোঝা যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy