অগস্ট থেকে জমতে শুরু করেছে। এক-এক করে এখন ৫৩টি। লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে ক্রাইম কন্ট্রোল রুমে যত্নে রাখা রয়েছে আলমারি বন্দি করে।
দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র নয়, দাঁত। এবং তা ডায়নোসরের নয়, মানুষের!
শহরের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ধার হওয়া ৫৩টি বেওয়ারিশ লাশের কষের দাঁত। যা থেকে মৃতের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। ওই সব মৃতদেহর কিছু দাহ করা হয়েছে, কিছু কবর দেওয়া হয়েছে। পরে অন্য কেউ এসে যদি কোনও দেহ তাঁর স্বজনের ছিল বলে দাবি করেন, এবং তা নিয়ে জটিলতা হয়, তখন সেই ব্যক্তির দাঁত থেকে সংগৃহীত ডিএনএ নমুনার সঙ্গে দাবিদারের শরীর থেকে নেওয়া ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখলে সত্য উদ্ঘাটন করা যাবে।
ওই ৫৩ জনের কেউ খুন হয়েছেন, কারও জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, আবার বা কেউ পথ দুর্ঘটনার শিকার। দাঁতগুলি প্লাস্টিকের ছোট ছোট কন্টেনারে রাখা রয়েছে বিশেষ ভাবে তৈরি আলমারিতে। ওই আলমারিতে পরের পর ড্রয়ার। প্রতিটি ড্রয়ারে ছোট ছোট খোপ। এক-একটি খোপে এক-একটি কন্টেনারে দাঁত। কন্টেনারের গায়ে থানার নাম, লাশ উদ্ধার হওয়ার দিনক্ষণ, মামলা বা জেনারেল ডায়েরি নম্বর, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুরতহাল নম্বর।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার জুলাইয়ে নির্দেশ দেন, এ বার থেকে বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন হলে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা হিসেবে মৃতদেহের কষের একটি দাঁত সংরক্ষণ করা হবে। তার পর থেকেই সংগৃহীত দাঁত গোয়েন্দা বিভাগে রাখা হচ্ছে ডিএনএ-র নমুনা হিসেবে।
গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রের খবর, বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে এত দিন ডিএনএ-র নমুনা হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু সংগ্রহ করে রাখা হতো না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, বিশেষ করে খুনের মামলা হলে গুরুত্ব বুঝে বেওয়ারিশ লাশের রক্ত, চুল বা নখ সংরক্ষণ করা হতো রাজ্য বা কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক গবেষণাগারে। আর কেন্দ্রীয় ভাবে কলকাতা পুলিশের কোনও সংস্থার তত্ত্বাবধানও ছিল না। দাঁতের বেলায় এখন যেটা করছে গোয়েন্দা বিভাগ। অজ্ঞাতপরিচয় দেহের ময়নাতদন্তের পরেই তার একটি কষের দাঁত চলে যাচ্ছে গোয়েন্দা বিভাগের জিম্মায়। গোয়েন্দা বিভাগের রেকর্ড সেকশনের ওসি এখন দাঁত সংরক্ষণের দায়িত্বে।
সুকুমার রায় গোঁফ দিয়ে মানুষ চেনার কথা লিখেছিলেন। এখন মানুষ চিনতে তা হলে হঠাৎ শুধু কষের দাঁতের উপর জোর দিচ্ছে কেন পুলিশ?
এক প্রবীণ ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, রক্ত, চুল, নখ, লালাও ডিএনএ-র নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে ডিএনএ বার করা, সেটাকে পরিশোধন করা ও পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে নমুনা হিসেবে তুলনামূলক ভাবে কষের দাঁত বেশি উপযুক্ত। ওই বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘সব চেয়ে বড় কথা, রক্তের নমুনা যেমন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংগ্রহ করতে ও সংরক্ষণ করতে হয়, কষের দাঁত দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করে রাখার ও সব ঝক্কি নেই।’’
লালবাজারে এখন ৫৩টি দাঁত রাখা আছে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। গোয়েন্দা বিভাগের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, ‘‘সংরক্ষণের ঝক্কি কম থাকায় ডিএনএ নমুনা হিসেবে দাঁত অনেক সুবিধাজনক। আমাদের কোনও হাসপাতাল বা গবেষণাগারের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না।’’
বছর কয়েক আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকা একটি মৃতদেহ তাঁদের পরিজনের বলে দাবি করেছিল দু’টি পরিবার। মৃতদেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, এমন দু’ধরনের ছবি দু’পক্ষই এনেছিল। শেষমেশ পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
২০১০-এর মার্চে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ মৃতদেহ শনাক্তকরণে সমস্যা হয়েছিল। কয়েকটি মৃতদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না, সেগুলোর মোট সংখ্যার চেয়ে দাবিদারের সংখ্যা ছিল বেশি। তখন ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছিল এবং নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছিল মৃতদেহের দাঁত ও পায়ের লম্বা হাড়।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, অগ্নিদগ্ধ, দুর্ঘটনায় থেঁতলে যাওয়া, বাড়ি চাপা পড়া কিংবা বিস্ফোরণে খণ্ড খণ্ড হওয়া বহু মৃতদেহ শনাক্তকরণ সম্ভব হয় না। মুখ ও শরীর এতটাই বিকৃত হয়ে যায়। জামাকাপড়েরও চিহ্ন থাকে না। এ সব ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
তবে অগস্ট মাসে ডিএনএ-র নমুনা হিসেবে দাঁত সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত লালবাজারকে ৫৩টির মধ্যে কোনও দাঁত থেকেই ডিএনএ সংগ্রহ করতে হয়নি। অবশ্য কোনও দাঁত ফেলেও দেওয়া যায়নি। কারণ, সেই দাঁতগুলোর মালিক ৫৩টি মৃতদেহ এখনও বেওয়ারিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy