ডুলুং ও সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী চরে গড়ে তোলা হয়েছে বহুমুখী জৈব কৃষি খামার।—নিজস্ব চিত্র।
সাঁকরাইল ব্লকের রোহিনী গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই এলাকাটি আসলে ডুলুং ও সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী নদীর চর। সেখানে চারশো একর জমিতে সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বহুমুখী জৈব কৃষি খামার। এলাকার সাতটি গ্রামের আড়াশোটি আদিবাসী-মূলবাসী পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটছে খামারে। আরও বেশি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এবার কোদোপালকে প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরতে চায় সাঁকরাইল ব্লক প্রশাসন। সেজন্য পর্যটন দফতর, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতর এবং উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষামূলক ভাবে সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির নিজস্ব উদ্যোগে কোদোপালে একটি মডেল কটেজও তৈরি করা হয়েছে। জঙ্গলমহলের অন্যতম দ্রষ্টব্য জায়গা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে কোদোপাল।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ডুলুং ও সুবর্ণরেখা নদীর মধ্যবতী এই চরটি প্রায় একশো বছর আগে পলি জমে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছিল। ঘন ঝোপঝাড়ে ভর্তি এলাকাটি ছিল শ্বাপদসঙ্কুল। ২০১২ সালে সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায় ওই এলাকাটিতে বিবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব পাঠান। এর পর স্যাটেলাইট ম্যাপিং করে পুরো জমিটি ছোট ছোট প্লটে ভাগ করা হয়। কোদোপালের চরটির মালিক জেলা ভূমি দফতর। তবে প্রকল্পটি রূপায়নের দায়িত্বে রয়েছে সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতি। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ঝোপঝাড় সাফ করে জমি সমতলীকরণ করা হয়। এলাকার আড়াইশোটি পরিবার এই কৃষি খামারে নিয়মিত কাজ পাচ্ছে। গত দু’বছরে ২৫ হাজার শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উদ্যানপালন দফতর, কৃষি দফতরের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের অর্থানুকুল্যে বহুমুখি ওই খামারে নানা ধরনের উন্নত প্রজাতির চার হাজার ফলের গাছ লাগোনো হয়েছে। রয়েছে আম, পেয়ারা, সফেদা, কুল, পাতিলেবু, গন্ধরাজ লেবু, মৌসাম্বি, লিচু প্রভৃতি গাছ। প্রতিটি গাছে শাওয়ার ইরিগেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ বার গ্রীষ্মের মরশুমে কোদোপালে প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ তরমুজের ফলন হয়েছিল। এর পাশাপাশি, ডুয়েল পারপাস-এ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল চাষ হচ্ছে। এই বর্ষায় বন দফতরের উদ্যোগে কোদোপালের ৫০ হেক্টর সরকারি জমিতে সেগুন, শিশু, মহুল, ঝাউয়ের মতো গাছ লাগানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দফতরের বরাদ্দ টাকায় এ পর্যন্ত প্রকল্পটি রূপায়নে ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।
সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “কোদোপাল কেবল কৃষি খামার নয়, এটিকে ঘিরে ইকোনমিক জোন তৈরি করার পথে আমরা অনেকটা সফল হয়েছি। এর ফলে, এলাকার ধিতপুর, হরেকৃষ্ণপুর, কুস্তুরিয়া, মাসাড়-শালবনির মতো সাতটি গ্রামের আড়াশোটি আদিবাসী-মূলবাসী পরিবারকে সারা বছর কাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এখানে প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র চালু হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আরও বেশি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।” কোদোপালের প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় দশজন আদিবাসী যুবককে। এখানে দু’ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটছে। প্রথমত, মাটি কাটা ও খামার পরিচর্যার জন্য কাজ পাচ্ছেন স্থানীয়রা। অন্য দিকে, যাঁদের চাষজমি নেই, তাঁদের চাষ করার জন্য একটা মরশুমের জন্য নাম মাত্র টাকায় জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে। উত্পাদিত কৃষিজ সামগ্রী বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। মাসাড়-শালবনির গীতা সিংহ, সুখমণি সিংহ, ধিতপুরের অঞ্জলি সিংহ-দের বক্তব্য, “দু’বছর আগেও ভিন জেলায় খেত মজুরের কাজ করতে যেতাম। এখন কৃষি খামারে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সারা বছর কাজ মিলছে।” সম্প্রতি কোদোপাল পরিদর্শন করে প্রকল্পটির ভূয়সী প্রশংসা করে গিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন। বিডিও জানান, কোদোপালের জমিতে কোনও রকম রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে না। কেবলমাত্র জৈব সার ব্যবহার করা হচ্ছে। সারের চাহিদা মেটানোর জন্য উপভোক্তাদের বাড়িতে বায়ো প্ল্যান্ট বসানোর জন্য নাবার্ডের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “কোদোপালের কর্মযজ্ঞে জেলা পরিষদের তরফে সব রকম সহযোগিতা করা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy