রং-তুলিতে: আঁকা শেখাচ্ছেন মন্টু। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
লম্বা হলঘরের মতো পেল্লায় বারান্দার এক দিকে বছর আটত্রিশের যুবক। তাঁর সামনে বিভিন্ন বয়সের জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে। সকলেই অখণ্ড মনোযোগে ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। কেউ রং-তুলিতে কিছু আঁকছে। কেউ প্যাস্টেলে রং চড়াতে ব্যস্ত। কেউ বা পেনসিল স্কেচে মগ্ন। কোনও সমস্যা হলেই তারা আঁকার বোর্ড এগিয়ে দিচ্ছে ‘মন্টু স্যার’-এর দিকে। তুলি বা পেনসিল দিয়েই ছবি সংশোধন করে দিচ্ছেন স্যার মন্টু।
বাঁশদ্রোণীর ১০৮ নম্বর পূর্ব আনন্দপল্লির লম্বা-টানা ওই দাওয়ার এমন শান্ত-স্নিগ্ধ ছবিটা অবশ্য আবহমান কালের নয়। মাত্র আট বছর আগে এই বাড়িতেই ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল মন্টু মণ্ডলের। এক লহমায় ছাপোষা মধ্যবিত্ত থেকে মন্টু হয়ে গিয়েছিলেন জেলের বন্দি। তিন মাস জেলের ঘানি ঘোরানোর পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে মন্টু বাড়ি ফিরে আসেন। তত দিনে অবশ্য আবার আগাগোড়া পাল্টে গিয়েছে মন্টুর জীবন।
২০০৯ সালের আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মন্টু বাবার সঙ্গে কাজ করতেন গ্রিলের ব্যবসায়। সেই ব্যবসায় থিতু হয়ে বিয়েও করেন। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে তখন মন্টুর ভরা সংসার। সেই সময়েই ঘটে যায় অঘটন। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় মন্টুর স্ত্রীর। সেই ঘটনার জেরেই জেলে যেতে হয় মন্টুকে। তিন মাস আলিপুর জেলে থাকেন তিনি। আর সেই জেল-জীবনই পাল্টে দেয় মন্টুকে।
গ্রিলের মিস্ত্রি মন্টু হয়ে যান চিত্রশিল্পী। আঁকার মাস্টারমশাই।
সালটা ২০০৮। আলিপুর জেলে তখনকার আইজি (কারা) বংশীধর শর্মার নেতৃত্বে বন্দিদের সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চিত্রশিল্পী চিত্ত দে-র কাছে আঁকাআঁকির তালিম নিচ্ছেন বন্দিরা। সেখানেই জীবনে প্রথম তুলি, পেনসিল হাতে নেন মন্টু। শেখেন ছবি আঁকার ‘অ-আ-ক-খ’।
‘‘জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময়ে ছবি আঁকা শেখাটা আমাকে একেবারে বদলে দিয়েছিল।
হতাশা কাটিয়ে জীবন নিয়ে ইতিবাচক চিন্তাটা আনতে আমাকে সাহায্য করেছে’’— পাখির ছবির উপরে রং বোলাতে বোলাতে বলছিলেন মন্টু। তিন মাস পরে জেল থেকে বেরিয়েও তাই ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। আঁকার পাঠ নিতে থাকেন চিত্তদার কাছে। গ্রিলের ব্যবসার পাট তত দিনে চুকে গিয়েছে।
বছরখানেকের মধ্যে আঁকার কাজে বেশ পটু হয়ে বাড়ির বারান্দাতেই আঁকার স্কুল খোলেন মন্টু। পাড়ার কচিকাঁচারা এখন আঁকার মন্টু স্যার বলতে অজ্ঞান। শনি-রবিবার ভোর হতে না-হতেই কচিকাঁচাদের কলরব বাড়িটাকে মুখর করে তোলে। পাল্টে গিয়েছে মন্টুর জীবন। আঁকাঅঁকিই এখন তাঁর জীবন ও জীবিকা। সপ্তাহের অন্যান্য দিন আঁকা শেখান স্কুলে। অনেকেরই বাড়ি গিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন আঁকার টিউশন।
যা দেখেশুনে কারা দফতরের কর্তারা উচ্ছ্বসিত। এক কর্তার কথায়, ‘‘জেলে সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময়ে অনেকেই বলেছিলেন, এ-সবে কিছু হয় না। মন্টুদের দেখলে সেই ধারণাটা পাল্টে যেতে বাধ্য।’’ অন্য এক কারাকর্তা জানাচ্ছেন, জেল কেন সংশোধনাগার, সেই প্রশ্নের সাক্ষাৎ জবাব মন্টু। কোনও বইয়ে এমন জীবন্ত জবাব মিলবে না।
এমন জবাব কি মানুষের ভিতরেই থাকে? শুধু টেনে আনার অপেক্ষা?
এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন চিত্ত দে, রং-তুলিতে যাঁর কাছে মন্টুর হাতেখড়ি। ‘‘চিত্রশিল্প এমনই একটা বিষয়, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের ভিতরের কথা প্রকাশ করে। মন্টু সেই কাজটাই করছে। আর এই শিক্ষা যে অনায়াসে অসংখ্য শিশুর মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া যায়, মন্টু তার একটা বেশ বড় প্রমাণ,’’ বলছেন চিত্তবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy