চোরাপথে শিশু বিক্রি হচ্ছে। আর তাতেই পড়ছে আইনি সিলমোহর!
শিশু পাচার তদন্তে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তিন কর্ণধার, পাঁচ জন নার্সিংহোম মালিক-সহ এখনও পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতারের পরে সিআইডি এ বার জাল গোটানো শুরু করেছে। আর এই পর্বে তারা জোর দিচ্ছে কী ভাবে চোরাই শিশুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনি সিলমোহর দিয়ে নিঃসন্তান দম্পতিদের হাতে তুলে দেওয়া হতো, সেই রহস্য উদ্ঘাটনে।
সিআইডি-র দাবি, দু’টি কায়দায় চোরাই শিশুকে আইনি তকমা দেওয়া হতো। জেরায় ধৃতেরাই সেই কায়দার কথা জানিয়েছে। ফলে সেই শিশু যাঁরা কিনতেন, তাঁরা কোনও প্রশ্ন তুলতেন না। অবাধে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা করে নিচ্ছিল শিশু কারবারিরা। কী সেই কায়দা?
১) যে সব নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে গরিব প্রসূতিদের সন্তানকে মৃত বলে ঘোষণা করে আড়ালে সরিয়ে ফেলা হতো। তার পর ওই নার্সিংহোমগুলিতে কোনও মহিলাকে (প্রসূতি নয়) টাকা দিয়ে ভর্তি করানো হতো। ওই মহিলা ‘সুস্থ’ বলে তৈরি হতো কাগজপত্র। পরে ওই মহিলা আদালতে গিয়ে কোনও দম্পতিকে (ক্রেতা) আইন মোতাবেক ‘তাঁর’ শিশুকে দত্তক দিতেন। গোটা প্রক্রিয়ার জন্য ওই ক্রেতাকে দিতে হতো ৬-৭ লক্ষ টাকা।
২) পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধীনে থাকা সরকার অনুমোদিত হোমে প্রথমে শিশু চুরি করে নিয়ে আসা হতো। তার পরে হোম কর্তৃপক্ষ থানায় গিয়ে অভিযোগে জানাত, শিশুটিকে হোমের সামনে ফেলে গিয়েছে কেউ। শুরু হতো মামলা। তার পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে শিশুটিকে নিজেদের হেফাজতে নিত হোম কর্তৃপক্ষ। তার পর তৈরি হতো আইনি কাগজপত্র। পরের ধাপে একই ভাবে ওই আইন মোতাবেক শিশু দত্তক দেওয়া হতো।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ধৃতেরা যা জানাচ্ছে, তা নিপুণ কারসাজিতে সংগঠিত চুরি। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কালো ব্যবসাকে সাদা দেখানো। বেহালার সাউথ ভিউ নার্সিংহোম, মহাত্মা গাঁধী রোডের
শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোম বা বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোমে যে ওই কায়দাতেই পাচারের আগে শিশুদের বৈধ কাগজপত্র তৈরি করা হতো, তা-ও ধৃতেরা স্বীকার করেছে। ধৃতদের মধ্যে নাজমা বিবি, উৎপলা ব্যপারী এবং বাসন্তী চক্রবর্তী নানা জায়গা থেকে গরিব পরিবারের প্রসূতিদের জোগাড় করত। সোহান নার্সিংহোমের মালিক সত্যজিৎ সিংহ, শ্রীকৃষ্ণের পারমিতা চট্টোপাধ্যায় এবং তার স্বামী পার্থ, সাউথ ভিউ-এর পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রভা প্রামাণিকের দায়িত্ব ছিল শিশুদের জন্য বৈধ কাগজপত্র তৈরির। উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা সদ্যোজাতদের চিকিৎসা করত সোহানের তপন বিশ্বাস। কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আনা শিশুদের চিকিৎসা করত শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ সামন্ত।
এ পর্যন্ত ধৃতদের মধ্যে বিমল অধিকারী এবং রিনা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’টি হোমের কর্ণধার। দু’জনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও রয়েছে। এ ছাড়াও, ফলতার দোস্তিপুরে দু’জনে আরও একটি সরকার অনুমোদিত হোম চালাত। সেখানে অনাথ শিশুদের রাখা হতো। তল্লাশির পরে সেখান থেকে ২০টি শিশুকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। এই তিনটি হোম এবং এবং মছলন্দপুরের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর মাধ্যমে কত শিশুকে আইনি তকমা দেওয়া হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সিআইডি জানিয়েছে। দেখা হচ্ছে ওই তিন নার্সিংহোমে রোগী ভর্তির খতিয়ানও।
গোয়েন্দাদের দাবি, বহু মানুষ ফোন করে নানা কথা জানাচ্ছেন। সোমবারই মছলন্দপুরের এক দম্পতি ভবানীভবনে সিআইডি দফতরে গিয়ে ধৃত হাতুড়ে তপন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। সিআইডিকে ওই ব্যক্তি জানান, ২০১৪ সালে তাঁর স্ত্রী প্রসববেদনা নিয়ে তপনের কাছে গিয়েছিলেন। তপন নিজের বাড়িতে স্ত্রীকে ভর্তি করিয়ে পরে জানায়, মৃত সন্তান প্রসব হয়েছে। এই অভিযোগের সারবত্তা খতিয়ে দেখছে সিআইডি। তাদের দাবি, কলকাতায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকের নামও পাচার-কাণ্ডের তদন্তে উঠে এসেছে।
গোটা ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রের খবর, তিনি পুলিশকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হোমগুলির উপর নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে সিআইডি এবং শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরও।
শিশু পাচার নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরাও। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। এই ব্যাপারে তাঁর তো এগিয়ে আসা উচিত ছিল। বিনা লাইসেন্সে কী ভাবে এ সব চলছিল!’’ শিশু পাচারের তদন্ত সিবিআইকে দেওয়ার দাবি তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘এ রাজ্যে আরও কোথায় এমন কত শিশু পাচার চক্র রয়েছে, তার হদিস পেতে একজন বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। তাঁর তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy