তালা বন্ধ পড়ে ট্রমা ইউনিট। —নিজস্ব চিত্র।
পুজোর অষ্টমীতে গাড়িতে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন একদল যুবক। ফেরার পথে কলাইকুণ্ডার জঠিয়ায় ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা মারে। জখমদের খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ইঞ্জিনিয়ার শেখ আক্রম ও মেদিনীপুর হোমিওপ্যাথি কলেজের অন্তিমবর্ষের ছাত্র অর্পণ পালিতের। মৃত আক্রমের দাদা আফসার আলির আক্ষেপ, “খড়্গপুর হাসপাতালে গিয়ে আমার ভাই কোনও চিকিৎসা পায়নি। অথচ এখানে ট্রমা কেয়ার ইউনিট থাকলে হয়তো ভাই বেঁচে যেত।’’
শুধু আফসার নন, এই আক্ষেপ খড়্গপুর মহকুমার অনেকেরই। কারণ, আট বছর আগে উদ্যোগ শুরু হলেও খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে ট্রমা কেয়ার ইউনিট চালু হয়নি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঢেলে সাজার কথা বলছেন, একের পর এক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের উদ্বোধন করছেন। জেলার নয়াগ্রামেও একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের উদ্বোধন হয়েছে সদ্য। খড়্গপুর হাসপাতালে ট্রমা কেয়ার ইউনিটের কাজ অবশ্য অনেকটাই এগিয়েছে। নতুন ভবন হয়েছে। এসেছে যন্ত্রপাতি।
এত কাজের পরেও ট্রমা ইউনিট চালু হচ্ছে না কেন? জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, চিকিৎসক ও জেনারেটরের অভাবে বিষয়টি থমকে রয়েছে। ফলে হাসপাতালে জরুরি বিভাগের দোতলায় নির্মিত ভবন ও যন্ত্রপাতিতে জমছে ধুলো। এ দিকে, বিভাগটি কেন চালু হল না তা জানতে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের তলব করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ট্রমা কেয়ার সংক্রান্ত খুঁটিনাটি জানতে আগামী ৯ ডিসেম্বর দিল্লির নির্মাণ ভবনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের। খড়্গপুর হাসপাতালের সুপার কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “ট্রমা ইউনিট চালুর জন্য চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীর অভাব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জেনারেটর। গত এক বছরে আমি নিজে দু’বার আবেদন করেও জেনারেটর পাইনি।’’ দিল্লি থেকে আসা চিঠির কথা রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীকে জানাবেন বলেও মন্তব্য করেন কৃষ্ণেন্দুবাবু।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরা অবশ্য বলেন, “দিল্লি থেকে চিঠি আসার কথা আমার জানা নেই। তবে ট্রমার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্কট রয়েছে রাজ্য জুড়েই। হাসপাতালের চিকিৎসক দিয়ে আপাতত ওই ইউনিট চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আগে প্রয়োজন। এ জন্য আমি বহুবার স্বাস্থ্যভবনে জানিয়েছি। দেখা যাক কী হয়!”
খড়্গপুর শহরের পূর্ব-পশ্চিমে মুম্বইগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ও উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে ওড়িশাগামী ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক। শহর জুড়ে বিস্তৃত রেলপথও। উভয়ত দুর্ঘটনাপ্রবণ এই শহরে ট্রমা কেয়ার ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা বিচার করেই ২০০৬ সালে রাজ্যের ৬টি জায়গার সঙ্গে খড়্গপুরেও এই ব্যবস্থা চালুর তোড়জোর শুরু হয়। কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে ভবন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ট্রমা ইউনিটের জন্য আলাদা করে ৩ জন সার্জেন, ৩ জন অর্থোপেডিক, ৩ জন অ্যানাস্থেটিস্ট, ৪ জন জেনারেল ডিউটি অফিসার ও ২৫ জন নার্স প্রয়োজন। একজন করে এক্স-রে ও ল্যাব টেকনিশিয়ানও দরকার। কিছু মাস আগে এক জন সার্জেন পাঠানো হলেও এখন তিনি বদলি হয়ে গিয়েছেন। আবার ৬ জন নার্সের ট্রেনিং হলেও তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে কর্মী ও চিকিৎসকের অভাবে ওই ট্রমা কেয়ার সেন্টারের দরজা এখন বন্ধ। তবে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারবার এই ট্রমা ইউনিট নিয়ে কথা বলেছেন। গত বছরের অগস্টে মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ণ পর্ষদের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতিও এই বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। এছাড়াও স্থানীয় বিধায়ক জ্ঞান সিংহ সোহন পালও বারেবারে স্বাস্থ্যভবনে তদ্বির করেছেন। তবে অবস্থা সেই তিমিরেই।
এই পরিকাঠামো ও শূন্যপদ পূরণ করে কবে ট্রমা কেয়ার ইউনিট চালু হবে তার সদুত্তর ভবন হওয়ার পর ৬ বছর পরেও অধরা। ২০১৪ সালের গোড়ায় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ‘হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার’ দফতরের আঞ্চলিক আধিকারিকেরা ঘুরে গিয়েছিলেন এই হাসপাতাল থেকে। দিল্লিতে তাঁরা এই ট্রমা চালুর জন্য চিকিৎসক-কর্মীর অভাবের কথা জানিয়ে চিঠিও দিয়েছেন। এর পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের যুগ্ম অধিকর্তা হিমাদ্রি সান্যালের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ইউনিটটি পরিদর্শন করেন। তার পরেও বছর ঘুরেছে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ইতিমধ্যে হাসপাতালে যে সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছেন তা দিয়েই ট্রমা ইউনিট চালাতে বলছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এই পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মুখ্য সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। গত ৪ ডিসেম্বর খড়্গপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেও এসে পৌঁছেছে সেই চিঠি। সেখানে জানানো হয়েছে কাল দিল্লির বৈঠকে উপস্থিত থেকে কেন এই ট্রমা ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না, বরাদ্দ টাকা কীসে খরচ হয়েছে, আর কী প্রয়োজন— এ সব বিস্তারিত জানাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy