Advertisement
১০ মে ২০২৪

কোর্টের ধাতানিতেই চাকরি নট মদনের

পনেরো মাস আগে যিনি মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা জমা দিয়েছিলেন, আজও তা গৃহীত হয়নি। এতেই বোঝা যায়, উনি কতটা প্রভাবশালী! সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত মদন মিত্র সম্পর্কে কলকাতা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছিল বুধবার দুপুরে। ক’ঘণ্টার মধ্যেই পট বদলে গেল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১৬
Share: Save:

পনেরো মাস আগে যিনি মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা জমা দিয়েছিলেন, আজও তা গৃহীত হয়নি। এতেই বোঝা যায়, উনি কতটা প্রভাবশালী!

সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত মদন মিত্র সম্পর্কে কলকাতা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছিল বুধবার দুপুরে। ক’ঘণ্টার মধ্যেই পট বদলে গেল। কার্যত চাপের মুখে পড়ে এ দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মদন মিত্রের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে নিলেন। নবান্ন সূত্রের খবর, পরিবহণমন্ত্রীর ইস্তফা-ফাইল রাজ্য সরকারের তরফে এ দিন রাতেই রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাজ্যপাল তা গ্রহণ করেছেন বলে বেশি রাতের খবর।

মন্ত্রীর ইস্তফা দীর্ঘ দিন ধরে কেন গৃহীত হয়নি, তাই নিয়ে এ দিন হাইকোর্টে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও তাপস মুখোপাধ্যায়ের তির্যক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন মদনের কৌঁসুলি। আদালত বলে, পনেরো মাস আগে পেশ করা ইস্তফা এখনও গৃহীত না-হওয়াই বলে দেয়, মদন মিত্রের ‘প্রভাব’ কতখানি। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, হাইকোর্টের মন্তব্যের পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকারকে মদনের ইস্তফা গ্রহণ করতে হল। রাতে মদন-ঘনিষ্ঠ এক নেতার মন্তব্য, ‘‘উনি তো অনেক আগেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। দলনেত্রী আগে গ্রহণ করলে হয়তো ভাল হতো।’’

মদন বিদায় প্রসঙ্গে এ দিন রাত পর্যন্ত তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কেউ ‘সরকারি ভাবে’ বিশদে মুখ খুলতে চাননি। শুধু পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কে মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন, কে হবেন না, সেটা মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। একই ভাবে কার ইস্তফা গৃহীত হবে আর কার হবে না, তা-ও একান্ত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর বিষয়। ফলে অযথা বিতর্ক অর্থহীন।’’ সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘বিধায়ক মদন মিত্রের জামিন আদালতের বিচারাধীন। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’

তবে তৃণমূলের অন্দরের বড় অংশের ব্যাখ্যা, এত দিন বাদে পরিবহণমন্ত্রীকে অব্যাহতি দিয়ে দ্বিমুখী কৌশল নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপ মদনকে ‘সাহায্য’ করার জন্যই। কারণ, আদালতে এর পরে মদনের কৌঁসুলি বলতে পারবেন, তাঁর মক্কেল আর প্রভাবশালী নন! ‘‘অন্য দিকে জামিন খারিজ হয়ে গেলে বিরোধীদের বলা যাবে, মদনের সঙ্গে আমরা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছি,’’ মন্তব্য দলের এক প্রথম সারির নেতার। তাঁর দাবি, ‘‘এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মদন-কাণ্ড থেকে হাত ধুয়ে ফেলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখা হল!’’ কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী বা বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্যদের অবশ্য দাবি, আদালতকে ‘প্রভাবিত’ করার লক্ষ্যেই হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত। নইলে ৩১ অক্টোবর জামিন পাওয়ার পরেও মদনবাবু মন্ত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। ৩ নভেম্বর তিনি পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে সই করেছেন গতিধারা প্রকল্পের ফাইলে।

সিবিআই অবশ্য মনে করছে, মদনের ইস্তফা গৃহীত হওয়ায় জামিন খারিজের মামলায় প্রভাব পড়বে না। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের দাবি, মন্ত্রী থাকুন বা না-থাকুন, জনমানসে মদন মিত্রের প্রভাব এখনও রয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর আলিপুর কোর্টে তাঁর জামিন মঞ্জুর হওয়ার পরে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সিবিআই হাইকোর্টে এসেছে। মঙ্গলবার মদনবাবুর তরফে হলফনামা জমা না-পড়ায় মামলাটির শুনানি হয়নি। বুধবার দিনভর শুনানি চললেও আদালত রায়দান স্থগিত রাখে। আজ, বৃহস্পতিবার ফের শুনানি হওয়ার কথা।

মঙ্গলবারের মতো এ দিনও সওয়াল-জবাবের ফাঁকে ফাঁকে উড়ে এসেছে বিচারপতিদের মন্তব্য, প্রশ্নবাণ ও কটাক্ষ। মদনবাবুর কৌঁসুলি সুরেন্দ্র কপূরকে একাধিক বার মাঝপথে থামিয়ে নানা প্রশ্ন করেছে আদালত।

কী রকম?

কপূর অনুযোগ করে বলেছিলেন, ‘‘পনেরো মাস আগে আমার মক্কেল মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন আর মন্ত্রী নন। অথচ সিবিআই বারবার বলতে চাইছে, তিনি মন্ত্রী হিসেবে প্রভাব খাটাবেন!’’ শোনামাত্র বিচারপতি মাত্রে তাঁকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘সে কী? আপনার মক্কেল মন্ত্রী নন! কিন্তু আগে হাইকোর্টে আপনাদের জামিন-আর্জিতে তো লেখা রয়েছে, আপনার মক্কেল বর্তমানে মন্ত্রী!’’ বিচারপতির স্মৃতিচারণা, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে, কপিল সিব্বল আপনার মক্কেলের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে (৬ অগস্ট) বলেছিলেন, জামিন পেলে উনি পদত্যাগ করতে চান। তার মানে, তখনও তিনি মন্ত্রী-ই ছিলেন!’’

এমতাবস্থায় আদালতের প্রশ্ন, মদনবাবু যদি আগেই মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে থাকেন, তা হলে উনি কী ভাবে নতুন করে পদত্যাগ করতে চাইবেন? পনেরো মাস আগে পদত্যাগ করেছেন বলারই বা কী অর্থ? মদনের কৌঁসুলি তখন থমকে যান। তার পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘আসলে উনি পদত্যাগ করেছেন ২০১৪-র নভেম্বরে। কিন্তু এখনও গৃহীত হয়নি।’’

এই সময়ে বিচারপতি মুখোপাধ্যায় পাশ থেকে বিচারপতি মাত্রের কানে-কানে কিছু একটা বলেন, যা শুনে বিচারপতি মাত্রে হেসে ফেলেন। কপূরকে উদ্দেশ করে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘দেখুন, আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বিচারপতি ঠিকই বলছেন। এক জন কতটা প্রভাবশালী হলে তাঁর পদত্যাগপত্র পনেরো মাসেও গৃহীত হয় না!’’ কপূরের সওয়ালের মাঝে বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখ করে বিচারপতি মাত্রে এ-ও বলেন, ‘‘আপনি নিশ্চয় বলবেন না যে, আপনার মক্কেল ঈশ্বরের চেয়েও পবিত্র ( হোলিয়ার দ্যান দাও)!’’

সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে কপূরের অভিযোগ ছিল, সারদার এক অনুষ্ঠানে মদনবাবু ওই সংস্থার পক্ষে কিছু ভাল কথা বলেছিলেন। শুধু তার ভিত্তিতেই সিবিআই ওঁকে গ্রেফতার করেছে। সারদার টাকা পাচারের সঙ্গে কোনও যোগ প্রমাণ করতে পারেনি। এটা শুনে বিচারপতি মাত্রে আবার তাঁকে থামিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে, মদন মিত্রের সারদা অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তিনি ওই গোষ্ঠীর কর্মী ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন।’’

চুপ করে যান কপূর। এর আগে সিবিআইয়ের কৌঁসুলি কে রাঘবচারিলুর অভিযোগ ছিল, ৩১ অক্টোবর নিম্ন আদালত বিকৃত, বেঠিক, খামখেয়ালি ও একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রীকে জামিন দিয়েছে। ‘‘বিচারক বোধহয় ঠিকই করে রেখেছিলেন যে, সে দিন শুনানি করবেন,’’ মন্তব্য করেন তিনি। বিচারপতি মাত্রে তখন প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি তো সে দিনের শুনানিতে ছিলেনই না! কী করে এমন আশঙ্কা করলেন?’’ সিবিআই কৌঁসুলি বলেন, ‘‘আমি সে দিন (৩১ অক্টোবর) নিম্ন আদালতের বিচারকের কাছে কার্যত এক দিন সময় ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কারণ, সে দিন তদন্তকারী অফিসার ছিলেন না। কেস ডায়েরিও ছিল না।’’ শুনে বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, কেস ডায়েরি ছাড়াই জামিন দেওয়া হয়ে থাকলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সেটা কতটা ন্যায়সঙ্গত হয়েছে!

সিবিআই আদালতকে জানায়, তারা গত ২৭ ও ২৮ অগস্ট এসএসকেএমে গিয়ে মদন মিত্রকে জেরা করেছে। রাঘবচারিলু বলেন, ‘‘মদন মিত্র নাকি তদন্তে সহযোগিতা করছেন! কিন্তু জেরায় কী প্রশ্ন করা হয়েছিল, আর কী উত্তর মিলেছে, তা আপনাকে দিয়েছি। আপনিই পড়ে দেখুন, কতটা সহযোগিতা উনি করছেন!’’ মদন মিত্রের প্রভাবের ‘প্রমাণ’ও এ দিন পেশ করেছেন সিবিআই-কৌঁসুলি। তাঁর অভিযোগ, জামিনের কুড়িটি শুনানিতে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে উনি আদালতে হাজির হননি। রাজ্য সরকারের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের যে ঘর রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ, সেখানেই তিনি মাসের পর মাস কাটিয়েছেন। জামিন লাভের পর দিনই বাড়ি চলে গিয়েছেন! ‘‘ওঁর ওষুধের লিস্টে তিনটে আলাদা কোম্পানির তৈরি একই ন্যাজাল ড্রপ তিন বার লেখা! এগারো জন ডাক্তার নাকি ওঁকে দেখছিলেন!’’ হাসপাতালের ‘ডিসচার্জ সামারি’ পেশ করে কটাক্ষ করেন রাঘবচারিলু। ওষুধের তালিকা দেখে দুই বিচারপতিও তখন হাসছেন।

এর পরে বেলা সওয়া বারোটায় কপূরের সওয়াল শুরু হয়। কপূর পুরনো এক মামলার প্রসঙ্গ টেনে দাবি করেন, ‘‘জামিনের আবেদন খারিজের সিদ্ধান্ত এক রকম। কিন্তু কারও জামিন পরে বাতিল করতে গেলে অভূতপূর্ব কারণ দেখাতে হবে।’’ শুনে বিচারপতি মাত্রের মন্তব্য, ‘‘নিম্ন আদালতের রায় বিকৃত, বেঠিক ও খামখেয়ালি হলে হাইকোর্ট তা খারিজ করতেই পারে।’’ এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি মাত্রের প্রশ্ন, ‘‘সে দিন কী এমন ঘটছিল যে, শুনানি এক দিনও পিছনো গেল না? আকাশ ভেঙে পড়েছিল? নাকি মদনবাবুকে হাসপাতাল থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল?’’ নিম্ন আদালতের বিচারক কীসের ভিত্তিতে মদনকে জামিন দিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। ‘‘উনি (বিচারক) তো জানতেন, ৬ অগস্ট হাইকোর্ট মদনের জামিন-আর্জি খারিজ করে দিয়েছে! তার পরে পরিস্থিতিতে বড়সড় পরিবর্তন হলে জামিন দেওয়া যেত। কিন্তু নিম্ন আদালতের নির্দেশে তো তেমন কিছুর উল্লেখ নেই!’’ কপূর জবাব দেন, ‘‘হতে পারে, নির্দেশ লেখার সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা বিচারক ঠিক ভাবে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে পারেননি।’’ বিচারপতি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘নির্দেশের কপি দেখে মনে হচ্ছে, বিচারক ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। ভাষার দক্ষতার অভাবে তিনি লেখেননি, এটা মানা যায় না।’’

শুনানি চলাকালীন ভিড়ের চাপে এজলাসের দরজার কাচ ভেঙে যায়। বিচারপতি মাত্রে তখন মদনবাবুর কৌঁসুলিকে বলেন, ‘‘কাচের টাকা আপনার মক্কেলের দেওয়া উচিত। ওঁর লোকজনই ভিড় করছেন।’’ করজোড়ে কপূর বলেন, ‘‘ধর্মাবতার বোধহয় ঠিক বলছেন না। এখানে যাঁরা আছেন, সকলে আইনজীবী। মদন মিত্রের শুধু দুই ছেলে উপস্থিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madan mitra resignation High court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE