ফোনে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নেওয়ার ভিড়। কাশীপুরে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
দশ টাকা ফেলুন, মহালয়া নিন।
মহালয়া মানে মহিষাসুরমর্দিনী। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কালজয়ী সৃষ্টি। মোবাইল ফোনের দোকানে এখন মেমরি কার্ড বা চিপ ফেললেই নিমেষে ভরে দেওয়া হচ্ছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। দক্ষিণা দশ টাকা।
তিরিশের দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি বাঙালির কাছে ‘আলোর বেণু’ না বাজলে মহালয়ার ভোর হয় না। তার পর ক্রমে সেই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং ক্যাসেট-সিডি হয়ে বাজারে বেরিয়েছে। ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে। মহালয়ার রেডিও-তে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন কার্যত পুরো দেবীপক্ষটাই মহিষাসুরমর্দিনীর মরসুম।
প্যান্ডেলের মাইক থেকে মোবাইলের কলার টিউন— ‘যা দেবী সর্বভূতেষু ছাড়া’ আলুনি যেন!
কিন্তু পুরুলিয়ার গ্রামে-গঞ্জে মানুষ পড়েছেন মুশকিলে! এফএম ছাড়া আকাশবাণী শোনার রেওয়াজ এখন অনেকটা কমের দিকে। অথচ পুরুলিয়ার অধিকাংশ প্রত্যন্ত এলাকায় এফএম তরঙ্গ পৌঁছয় না।
ইন্টারনেট সংযোগও দুর্লভ। সেখানে তাই মহিষাসুরমর্দিনী-র আগমন মোবাইল-বাহনে!
ঠিক মোবাইলও না, বলা ভাল মেমরি-কার্ড বাহনে!
বহু গ্রামের বহু মানুষের হাতে আজকাল স্মার্টফোন থাকলেও এফএম না থাকায় অর্ধেক আনন্দ মাটি। মুশকিল আসান মেমরি কার্ড। পুজোর দিন যত এগিয়ে আসছে, ঝালদা, হুড়া, কাশীপুর, বলরামপুরের দোকানগুলিতে কলেজপড়ুয়া থেকে সব্জি বিক্রেতা, রিকশাচালক থেকে সরকারি কেরানিদের মোবাইলে মেমরি ভরার ভিড় বাড়ছে। দোকানে দোকানে লিখে দেওয়া হয়েছে, ‘‘মহালয়া মোবাইলে নিন!’’ ঝালদার মোবাইল দোকানি টিপু সুলতানের কথায়, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই পুজোর আগে লোকজন এসে মেমরি কার্ডে মহিষাসুরমর্দিনী ভরে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিলেন। তাঁদের চাহিদা দেখেই ভরে দিচ্ছি।’’ তিনি জানান, দৈনিক ৫০-৫২ জন মোবাইলে ভরছেন। আবার কাশীপুরের দোকানি রাজীব মাহাতো বলছেন, এমনও দিন যাচ্ছে, যেদিন সংখ্যাটা ৭০-৭৫ জন পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে।
আজও এই জনপ্রিয়তার বহর দেখে স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ‘জাগো তুমি জাগো’-র
গায়ক বলেন, ‘‘যখন অনুষ্ঠানটা রেকর্ড হয়েছিল, সবাই অন্তর ঢেলে কাজ করেছিলাম। সেটাই জাদুর মতো কাজ করছে এখনও।’’ লোক-গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর মতে, পুরনো দিনের প্রতি বাঙালির আসক্তি ও শ্রদ্ধা বরাবরের। সে ধারা এ প্রজন্মেও বহাল আছে। বাস্তবিকই। পুঞ্চা ব্লকের লাখরা গ্রামের যুবক সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই দিলেন, ‘‘আমি মোবাইলে মহিষাসুরমর্দিনী নিয়েছি। বাড়িতে সবাই মিলে শুনব।’’
কাশীপুর মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছাত্রী বিনতা হাঁসদা, মঞ্জু মুর্মুদের কথায়, ‘‘কিছু কিছু জিনিসের কৌলীন্য কখনও কমে না। মহিষাসুরমর্দিনীও তেমনই।’’
কিন্তু এ ভাবে অনুষ্ঠানটি ডাউনলোড করে বিক্রি করলে কি কপিরাইট ভাঙা হচ্ছে না? ‘দ্য ইন্ডিয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি’-র রিজিওনাল ম্যানেজার প্রীতীশ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, গান ডাউনলোড করে বিক্রি করার জন্য ‘ফোনোগ্রাফিক পারফর্মেন্স লিমিটেড’ অথবা ‘ইন্ডিয়ান পারর্ফমিং রাইটস সোসাইটি লিমিটেড’-র অনুমতি নেওয়া উচিত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাজারে এনেছিল এইচএমভি। সারেগামা (এইচএমভি)-র পরামর্শদাতা এস এফ করিম বলছেন, ‘‘ওই অনুষ্ঠানের কপিরাইটের অংশ এখনও সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা তাঁদের পরিবার পান। তাই ইন্টারনেটে ওটা চুরি করলে তাঁদের ঠকানো হয়।’’
আইনি ব্যাপারটা নিশ্চয় জানেন পুরুলিয়ার একটি থানার সেই অফিসার, যিনি ইতিমধ্যেই মেমরি কার্ডে মহিষাসুরমর্দিনী ভরিয়েছেন। কিন্তু আইনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার তাগিদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অফিসারের বক্তব্য, ‘‘মহালয়ার দিন কোথায় ডিউটি পড়বে জানি না। কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনী না শুনলেও নয়। তাই...।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy