Advertisement
০৮ মে ২০২৪

পুলিশ কোথায়, গ্রাম ছাড়ার ঢল মাখড়ায়

রক্ত ঝরা সংঘর্ষের পরে কেটে গিয়েছে গোটা একটা দিন। মাখড়া গ্রামে আতঙ্কের ছায়াটা একই রকম স্পষ্ট। সোমবার যখন পাড়ুইয়ের ওই গ্রামে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ছে, গুলি ছুটছে, তখন পুলিশ আসেনি। তারা এসেছিল সংঘর্ষ থামার পরে। মাখড়া গ্রামে পুলিশের দেখা মিলল না মঙ্গলবারও। আতঙ্কিত বাসিন্দাদের ভয় কাটাতে গ্রামে আসেননি বীরভূম জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কোনও কর্তাই। এ দিনও এক দল পুলিশ অবশ্য চোখে পড়েছে।

আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছেন মাখড়ার বাসিন্দারা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছেন মাখড়ার বাসিন্দারা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

দয়াল সেনগুপ্ত ও মহেন্দ্র জেনা
মাখড়া (পাড়ুই) শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩০
Share: Save:

রক্ত ঝরা সংঘর্ষের পরে কেটে গিয়েছে গোটা একটা দিন। মাখড়া গ্রামে আতঙ্কের ছায়াটা একই রকম স্পষ্ট।

সোমবার যখন পাড়ুইয়ের ওই গ্রামে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ছে, গুলি ছুটছে, তখন পুলিশ আসেনি। তারা এসেছিল সংঘর্ষ থামার পরে। মাখড়া গ্রামে পুলিশের দেখা মিলল না মঙ্গলবারও। আতঙ্কিত বাসিন্দাদের ভয় কাটাতে গ্রামে আসেননি বীরভূম জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কোনও কর্তাই। এ দিনও এক দল পুলিশ অবশ্য চোখে পড়েছে। তা অবশ্য মাখড়া থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কুলতোড় সেতুর কাছে! আর এক দল ছিল মাখড়া থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের হাঁসড়া স্কুল মোড়ে, ইলামবাজার-বোলপুর পিচ রাস্তার ধারে। পুলিশের এই ভূমিকায় আতঙ্ক আরও চেপে বসছে এলাকায়। তাই দলে দলে গ্রাম ছাড়ছেন বাসিন্দারা। গ্রামের মসজিদ থেকে সমানে গ্রাম না ছাড়ার জন্য আবেদন জানানো সত্ত্বেও তল্পিতল্পা গুটিয়ে যে যেমন পারছেন গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

আর যাঁরা গ্রামে থেকে যাচ্ছেন, তাঁরা মরিয়া হয়ে এককাট্টা হয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ না থাকার সুযোগে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা ফের যে কোনও সময় হামলা চালাতে পারে। তাই নিজেরা এক হওয়া দরকার। মঙ্গলবার গ্রামে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কোথাও গ্রামবাসীরা যৌথ উদ্যোগে রান্নাবান্না করছেন। কোথাও একযোগে চলছে পরিবেশন এবং খাওয়াদাওয়া।

সোমবার এই গ্রামেই বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে যে তিন জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের দু’জন মাখড়া গ্রামেরই বাসিন্দা। ১৯ বছরের শেখ তৌসিফ আলির পরিবার বিজেপি সমর্থক। আর এক নিহত শেখ মোজাম্মেল হক এলাকার সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। সংঘর্ষের পরে সোমবার রাতেই গ্রামবাসীদের বড় অংশ ঠিক করেন, রাজনীতি নিজের জায়গায় থাকুক। কিন্তুআর রক্ত যেন না ঝরে, তা দেখতে হবে। ঠিক হয়, তৌসিফ ও মোজাম্মেলের সৎকার হবে এক সঙ্গে। মঙ্গলবার সেই মতো সৎকারের জন্য চাঁদাও দেন গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা। পশ্চিমপাড়ার মঞ্জিল ইসলাম, উত্তরপাড়ার গোলাম মর্তুজারা বলেন, “রাজনৈতিক রং দেখা হয়নি। যে যার সাধ্য মতো চাঁদা দিয়েছেন।”

সমস্ত আয়োজন যখন প্রায় শেষ, তখন খবর আসে, সিউড়ি হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হবে না মৃতদের। বুধবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পরে দেহ দেওয়া হবে পরিবারের হাতে। এই খবরে গ্রামে ক্ষোভ আরও বাড়ে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, গ্রামবাসীদের এই ‘ঐক্য’ কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, কতটাই বা রাজনৈতিক চাপের জের। মাখড়া গ্রামটি বিজেপি-র নিয়ন্ত্রণে। তৃণমূলের বেশ কিছু পরিবার ঘরছাড়া। বীরভূম জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “গ্রামে পুলিশ নেই। লোকজন অধিকাংশই বিজেপির। আর আমাদের যে সামান্য সংখ্যক কর্মী-সমর্থক আছেন, তাঁদের এক জন মারা গিয়েছেন। তাঁর দাদা হাসপাতালে ভর্তি। তাই ওই গ্রামে থেকে বিজেপি-র বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো সাহস তাঁরা দেখাতে পারছেন না।” গ্রামের কিছু তৃণমূল সমর্থকও নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, “বিজেপি-র দখলে গোটা গ্রাম। আর আমাদের এখানেই থাকতে হবে। তাই ওদের সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় কী?” তাই আপাত ‘ঐক্যে’র ছবি গ্রাম জুড়ে।

এই ‘ঐক্যে’র পাশাপাশিই এ দিন মাখড়ায় গিয়ে চোখে পড়ল, গ্রামের ঢালাই রাস্তা ধরে দলে দলে বাক্স-প্যাঁটরা হাতে গ্রাম ছাড়ছেন পুরুষ-মহিলারা। সাইকেলে, মোটরবাইকে, মোটরচালিত ভ্যানে যে যেমন পারছেন, সেই ভাবেই গ্রাম ছাড়ছেন। অনেকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির গবাদি পশুগুলিকেও। পরের পর পরিবার গ্রাম ছাড়ছে দেখে স্থানীয় উত্তরপাড়া মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা শুরু হল, ‘আপনারা কেউ গ্রাম ছাড়বেন না। কোনও ভয় নেই। কেউ আক্রমণ করবে না।’

কিন্তু, সেই আবেদনে তেমন কাজ হচ্ছে না। তৌসিফ আর মোজাম্মেলের দেহ এ দিন আর গ্রামে পৌঁছবে না, এই খবর কানে আসতেই তড়িঘড়ি দুবরাজপুরের রেঙ্গুনি গ্রামে বাপের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন মাখড়া গ্রামের বধূ উম্মেসালমা বিবি। সোমবার গ্রামে গুলি, বোমার লড়াই আর দু-দু’টি মৃত্যু চূড়ান্ত ভয় ধরিয়ে দিয়েছে গ্রামের সকলের মতো তাঁকেও। বললেন, “ঘটনার পরই গ্রামে কিছু সময়ের জন্য পুলিশ ঢুকেছিল। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশের টিকিও দেখা যায়নি। পুরো গ্রাম আতঙ্কে ভুগছে, পাছে আবার আক্রমণ হয়! সেই জন্য সাত আর তেরো বছরের দুই মেয়েকে সোমবার বিকেলেই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।” তাঁর মতে, বাড়ির পুরুষেরা তা-ও অন্যত্র রাত কাটাতে পারেন। কিন্তু মহিলারা?

“তাই আজ নিজেই চললাম। কীসের ভরসায় গ্রামে থাকব বলতে পারেন?”পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে হাঁটা লাগালেন উম্মেসালমা। তাঁর মতোই গ্রামের মায়া ত্যাগ করে আপাতত অন্যত্র চলে গিয়েছেন জনিফার বিবি, রাজিয়া বিবি, নজমা বিবিরা। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন, “আগে পরিস্থিতি বুঝি। তার পর না হয় ফেরার কথা ভাবা যাবে!”

পুজোর পরে সোমবারই খুলেছিল মাখড়া প্রাথমিক স্কুল। জনা দশেক পড়ুয়া আর শিক্ষক হাজির ছিলেন। সারাটা সময় গুলি-বোমার শব্দে ভয়ে কেঁপেছেন। স্কুল খুলেছে মঙ্গলবারও। শিক্ষকেরা এলেও ১৫৫ জন পড়ুয়ার কেউই আসেনি। প্রধান শিক্ষক শেখ ফজলুল হক বললেন, “গ্রামে আতঙ্কের ভাব আছে। হয়তো সে জন্যই কেউ আসেনি।” আবার গ্রামের যুবক শেখ নুর ইসলাম, শেখ বাবর, শেখ মুর্তজারা বলছেন, গ্রামে পুলিশ এসে যদি নিরাপত্তার আশ্বাসও দিত, তা হলে অনেকেই গ্রাম ছাড়তেন না। কিন্তু, পুলিশেরই তো দেখা মিলছে না!

কেন মিলছে না, এ প্রশ্নের উত্তর সোমবারের মতো এ দিনও যথারীতি মেলেনি জেলার পুলিশকর্তাদের কাছে। তবে, রাজ্য পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “বারবার দোষারোপ করা হচ্ছে পুলিশকে। অথচ, সংঘর্ষ থামাতে ওই গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোনও নির্দেশই ছিল না প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে। তা ছাড়া, লাঠিধারী পুলিশের পক্ষে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের সঙ্গে লড়াই করার মতো পরিস্থিতিও ওখানে ছিল না।” তাঁর প্রশ্ন, বীরভূমেই এক সাব-ইনস্পেক্টর সম্প্রতি রাজনৈতিক সংঘর্ষের মাঝে পড়ে মারা গিয়েছেন। পাড়ুই থানার ওসি বোমা উদ্ধারে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ওই জেলায় পুলিশের নিরাপত্তা কোথায়? আর এক পুলিশ কর্তার মতে, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসী মারা যাওয়ার ঘটনা জাতীয় স্তরে আলোড়ন ফেলে গিয়েছিল। এই ক্ষেত্রে সেই রকম কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলেও সেই পুলিশকেই কাঠগড়ায় তোলা হতো!

এ দিনই সন্ধ্যায় নিহত মোজাম্মেলের দিদি তথা ইলামবাজার পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা নুরেলা বিবি পাড়ুই থানায় ২৩ জন বিজেপি কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযুক্তদের তালিকায় এক নম্বরে নাম রয়েছে স্থানীয় বিজেপি নেতা সদাই শেখের। মাখড়া লাগোয়া চৌমণ্ডলপুর গ্রামের (এখানেই গত শুক্রবার বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হন পাড়ুই থানার ওসি) বাসিন্দা এই সদাই এক সময় এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা ছিলেন। বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন সদাই। সেই সময় তাঁর বাবা ও সদাইয়ের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল বলে জানিয়েছেন নিহত মোজাম্মেলের মেয়ে সাবিনা বিবি। নুরেলা বিবিকে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি এখন অন্য রকম। আমি এখন কিছু বলব না।” জেলা তৃণমূল নেতা মলয়বাবু অবশ্য অভিযোগ করেছেন, “এফআইআর করার পরেই ফোনে নুরেলা বিবিকে হুমকি দেয় সদাই শেখ। বলে, ‘কী ভাবে তুই ফিরিস দেখছি’!” নিহত আর এক তৃণমূল কর্মী শেখ সোলেমানের স্ত্রী আমপাড়া বিবি পাড়ুই থানাতেই খুনের অভিযোগ করেছেন। তবে, লিখিত অভিযোগে তিনি বিজেপি নয়, সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের কথা উল্লেখ করেছেন।

অন্য দিকে, তৃণমূলের ২০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত তৌসিফের বাবা শওকত আলি। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলাম। বোলপুরের বিজেপি নেতা বলাই চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এর আগে ইলামবাজারের বিজেপি কর্মী রহিম শেখকে হত্যার ঘটনাতেও জাফারুল মূল অভিযুক্ত। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরেনি। সেই জাফারুলের নেতৃত্বেই সোমবার তৃণমূল মাখড়া গ্রামে হামলা চালিয়েছিল।” জাফারুল অবশ্য বলেন, “সোমবার সারা দিন আমি জেলা পরিষদে ছিলাম। এখন শুনছি, আমার নামেই নাকি অভিযোগ হয়েছে! মাখড়ার ঘটনার সঙ্গে আমি বা আমার দল কোনও ভাবেই জড়িত নয়।” উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিজেপি তাঁর নাম এফআইআরে ঢুকিয়েছে বলে জাফারুলের দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE