Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাজনীতির দাপটে ফের সরতে চেয়ে চিঠি অধ্যক্ষের

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির চাপ সহ্য করতে না পেরে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মালদহ কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কালাম মহম্মদ আনুয়ারুজ্জামান। অধ্যক্ষ তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর কাছে।

আব্দুল কালাম মহম্মদ আনুয়ারুজ্জামান

আব্দুল কালাম মহম্মদ আনুয়ারুজ্জামান

নিজস্ব সংবাদদাতা
মালদহ শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৩
Share: Save:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির চাপ সহ্য করতে না পেরে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মালদহ কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কালাম মহম্মদ আনুয়ারুজ্জামান। অধ্যক্ষ তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। প্রতিলিপি পাঠিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। সেখানে আনুয়ারুজ্জামান জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত কারণেই ইস্তফা দিতে চান। কিন্তু তাঁর সহকর্মী ও ছাত্রদের অনেকেই মনে করছেন, শাসক দলের নিরন্তর চাপ সহ্য করতে না পেরেই তিনি সরে যেতে চাইছেন।

কেন ইস্তফা? আনুয়ারুজ্জামান বলেন, ‘‘আমাকে বলা হয়, আমি নাকি কলেজের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছি!’’ কী সেই সর্বনাশ? ‘‘কলেজে ভর্তির সময় বিভিন্ন মহল থেকে চাপ এসেছিল। আমি নত হইনি। কলেজে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেরেছি। এটাকেই সর্বনাশ বলা হচ্ছে!’’—বলেছেন তিনি। কিন্তু কারা তাঁকে এই কথা বলেছেন, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি আনুয়ারুজ্জামান।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নাক গলাবে না— এই ছিল তৃণমূল জমানার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে বারবার দেখা গিয়েছে, এটা শুধুই কথার কথা। এমনকী, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত একাধিক বার জোর গলায় জানিয়েছেন, সরকার যখন মাইনে দেয়, নাক গলাতে বাধা কোথায়! সেই ‘ঐতিহ্য’ বজায় রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ আরও এক বার উঠল মালদহ কলেজের ক্ষেত্রেও।

এ বছরের গোড়ায় এই কলেজ প্রাঙ্গণেই সাড়ম্বরে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাদিবস পালন করা হয়। যা দেখে অনেকেই বলেছেন, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, শাসক দলের রাজনীতি কতটা শিকড় ছড়িয়েছে! এমন পরিস্থিতিতে অধ্যক্ষ ইস্তফা দেওয়ায় জল্পনা আরও বেড়েছে। বিরোধীপক্ষ আঙুল তুলেছে এলাকার এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর দিকে। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি মৌসম বেনজির নুরের কথায়, ‘‘পিছনে বড় খুঁটি না থাকলে এ ভাবে এক সর্বজনপ্রিয় অধ্যক্ষকে এত চাপ দিতে পারত না তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন।’’

মুখে না বললেও সকলেরই আঙুল কৃষ্ণেন্দুবাবুর দিকে। এ বার ছাত্রভর্তির সময়েও তাঁকে বা টিএমসিপি-কে অধ্যক্ষ রেয়াত করেননি বলেই স্থানীয় সূত্রে খবর। অভিযোগ, আর তাতেই দলের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমে চাপ বাড়িয়েছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে সম্প্রতি ‘সেন্সর’ করেছেন দলীয় নেতৃত্ব। তবে আনুয়ারুজ্জামানের ইস্তফার ব্যাপারে তাঁর কোনও হাত নেই বলে মনে করেন দলের শীর্ষ নেতারা। যদিও বিরোধীপক্ষ সে কথা উড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, যাঁর ‘পৃষ্ঠপোষকতায়’ কলেজ প্রাঙ্গণে দলের পতাকা তোলা হল, এ ক্ষেত্রে তাঁকে কী ভাবে ধমক দেবে দল? কৃষ্ণেন্দুবাবু এই নিয়ে কিছুই বলতে চাননি।

আনুয়ারুজ্জামানের উপরে চাপ তৈরির ঘটনা এই প্রথম নয়। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আট দিনের মধ্যে তিন বার তাঁকে ঘেরাও করেছিল টিএমসিপি। তখনই আনুয়ারুজ্জামান পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন কৃষ্ণেন্দুবাবুর কাছে। সেটা গত বছর জুলাইয়ের কথা। সে যাত্রায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান হয়। শেষ পর্যন্ত ইস্তফাপত্র তুলে নেন আনুয়ারুজ্জামান। কিন্তু তার পরে পাঁচ মাসও কাটল না। বৃহস্পতিবার ফের তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন দু’জনের কাছে। যা নিয়ে পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘আগে একবার বুঝিয়েছিলাম। আবারও কথা বলব। কিন্তু উনি থাকতে না চাইলে, অন্য লোক খুঁজতে হবে।’’

আর কৃষ্ণেন্দুবাবু? রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য, এলাকার এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা তথা কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি বললেন, ‘‘আমি কোনও ইস্তফাপত্র পাইনি। তাই এই বিষয়ে মন্তব্যও করব না।’’

আনুয়ারুজ্জামান অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘ইস্তফাপত্রটি পরিচালন কমিটির সভাপতিকে চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর শিক্ষামন্ত্রীকে মেল করেছি।’’ শিক্ষামন্ত্রীকে পাঠালেন কেন? আনুয়ারুজ্জামানের জবাব, ‘‘আমি আগেও ইস্তফা দিতে চেয়েছিলাম। শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধে অবস্থান থেকে সরে এসেছিলাম। তাই এ বার তাঁকেও জানানো দরকার বলে মনে করেছি।’’

আনুয়ারুজ্জামান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় শিক্ষক বলেই পরিচিত। ভূগোলের এই অধ্যাপকের শিক্ষকতা শুরু মালদহ কলেজেই। তার পরে তিনি এই কলেজেই অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। প্রথম থেকেই তাঁর দৃঢ় মনোভাবে তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগে বলে স্থানীয়দের দাবি। অধ্যক্ষর ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, টিএমসিপির নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্র সংসদ নিজেদের তহবিল বাড়ানোর জন্য তাঁর উপরে সমানে চাপ দিচ্ছিল। সেই দাবিকে অধ্যক্ষ আমল দেননি। সেই চাপ বাড়তে থাকে। ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি বাবুল শেখের বক্তব্য, ‘‘অধ্যক্ষকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে পারছিল না টিএমসিপি। তাই চাপ বাড়িয়ে তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হল।’’ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি প্রসেনজিৎ দাস অবশ্য বলেন, ‘‘অধ্যক্ষকে আমরা সম্মান করি। কোনও অনৈতিক দাবি আমরা তাঁর কাছে করিনি। তাই তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তা বলতে পারব না।’’

মাত্র কয়েক দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাশের জেলা উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি সহ্য করব না।’’ তার পরেও কেন আবার এমন ঘটনা, এর কোনও সদুত্তর কিন্তু নেই জেলার তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE