সিট বেল্ট না বাঁধার ঐক্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গাড়িচালকের পাশের আসনে বসে কলকাতায় আসছিলেন বর্ধমানের এক ব্যবসায়ী। উত্তরের এক রাস্তায় হঠাৎই হাত দেখালেন এক পুলিশকর্মী। গাড়ি থামাতেই বললেন, ‘‘১০০ টাকা জরিমানা দিন। কারণ, সামনের আসনে বসেও আপনি সিট বেল্ট বাঁধেননি।’’
প্রথমে ওজর-আপত্তি করলেও পুলিশের যুক্তি মেনে জরিমানা মেটান ওই ব্যবসায়ী। তার পরে যখন নিজের গাড়িতে উঠছেন, তখনই সামনে দিয়ে চলে গেল লালবাতি লাগানো একটি সাদা স্করপিও। চালকের পাশে রাজ্যের এক মন্ত্রী, তিনিও সিট বেল্ট বাঁধেননি। এবং ওই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা পুলিশকর্মী তা দেখেও তখন স্যালুট ঠুকছেন!
পথ-নিরাপত্তা সপ্তাহে কলকাতা পুলিশের স্লোগান ছিল, ‘চলো নিয়মমতে’। অর্থাৎ নিয়ম মেনে চললে পথ নিরাপদ হবে। না হলে পড়তে হবে জরিমানার মুখে। সিট বেল্ট বাঁধা নিয়ে আদালতের নির্দেশও আছে। নিয়ম যে অমূলক, তা-ও বলছেন না কেউ। তবু আমজনতার অভিজ্ঞতা, পথের নিয়ম শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই। মন্ত্রী-সান্ত্রীরা যেন তার ঊর্ধ্বে। প্রশ্ন উঠেছে, সিট বেল্ট না বাঁধা যদি আদালতগ্রাহ্য অপরাধ হয়, তবে মন্ত্রী-সান্ত্রী-নেতারাই বা ছাড় পাবেন কেন?
উত্তর জানতে বারবার ফোন করা হয় যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকারকে। তিনি ফোন ধরেননি। ফোন করা হয় কলকাতা পুলিশের কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে। তিনি বলেন, ‘‘যা বলার ডিসি (ট্রাফিক) বলবেন।’’ ডিসি (ট্রাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমার বলেন, ‘‘আমরা অনিয়ম দেখলেই ব্যবস্থা নিই। তবে মন্ত্রীদের কথা আমি বলতে পারব না।’’
পুলিশ বলতে না পারলেও এ রাজ্যের প্রায় সবাই জানেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী গাড়ির সামনের সিটে বসেন। তাঁকে বেল্ট বাঁধতেও দেখা যায় না। কলকাতার রাস্তায় মেয়র, দল নির্বিশেষে মন্ত্রিসভার বড়-মেজ-ছোট সদস্য এমনকী, পাড়ার কাউন্সিলর বা স্থানীয় স্তরের নেতারা পর্যন্ত গাড়ির সামনের সিটে বসে কখনও সিট বেল্ট বাঁধেন না। রাজপথে ঘুরে বেড়ালেও তাঁদের কাউকে জরিমানা করা তো দূরে থাক, হাত দেখিয়ে দাঁড় করাতেও ‘সাহস’ পান না কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। লালবাজারের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘সিট বেল্টের জন্য প্রভাবশালীদের জরিমানা করতে হলে তো মুখ্যমন্ত্রীর থেকে শুরু করতে হবে। শেষ কোথায় কেউ জানেন না।’’ পুলিশের অন্দরের খবর, সিট বেল্ট না বাঁধা নিয়ে জরিমানা করতে হলে সেই তালিকা গিয়ে ঠেকবে লালবাজারের অন্দরমহলেও। কারণ, গাড়ির সামনের সিটে বসা পুলিশ অফিসারেরা তো নিজেরাই সিট বেল্ট বাঁধার ধার ধারেন না।
গাড়ির দূষণ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে। লালবাজারের অন্দরের খবর, বাস-ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে কালো ধোঁয়া বেরোলে পুলিশ ধরে। কিন্তু কলকাতা পুলিশের গাড়ি দূষণ ছড়াচ্ছে বলে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল লালবাজারে। পুলিশেরই অনেকে বলছেন, যে সব গাড়ি তাঁরা ব্যবহার করেন, তার ইঞ্জিন কতটা উন্নত কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ঠিক মতো হয় কি না, সে সব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বাহিনীর অন্দরেই। দক্ষিণ শহরতলির এক থানার অফিসার বলছেন, ‘‘আমাদের এমন গাড়ি রয়েছে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় বেরোলে জরিমানা অবধারিত ছিল।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, এমন নানা অভিযোগের ভিত্তিতে গত জুলাই মাসের শেষ দফায় লালবাজারের শীর্ষ স্তর থেকে সব গাড়ির দূষণ পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় মেরামতির নির্দেশ দেওয়া হয়। অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সব গাড়ির দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা করানো হয়েছে এবং সব ক’টি গাড়ি পাশও করেছে। লালবাজারের এক অফিসার বলেন, ‘‘বেশির ভাগ গাড়ির সাইলেন্সার পাইপ বদলে ফেলা হয়েছে। এখন আর কালো ধোঁয়া বেরোনো কলকাতা পুলিশের গাড়ি দেখা যাবে না।’’ কিন্তু এই নির্দেশিকা না মেলা পর্যন্ত পুলিশের গাড়ি যে যথেচ্ছ দূষণ ছড়িয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন তিনি।
এই দূষণ প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে কলকাতা পুলিশের এক আইনি মারপ্যাঁচ। বাম জমানার শেষ দিকে কলকাতা পুলিশ একলপ্তে অনেকগুলি গাড়ি কিনেছিল। সব ক’টিই ভারত স্টেজ-৩ গোত্রের। কিন্তু আলিপুর বা বেলতলার পরিবহণ দফতরে তখন ভারত স্টেজ-৩ ইঞ্জিনের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা শহরে তত দিনে অবশ্য ভারত স্টেজ-৪ ইঞ্জিন চালু হয়ে গিয়েছে। কর্তাদের মান বাঁচাতে শেষে বর্ধমান পরিবহণ দফতর থেকে ওই গাড়িগুলির রেজিস্ট্রেশন করানো হয়েছিল।
লালবাজারের এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘বর্ধমান থেকে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করানো বেআইনি নয়। তবে দূষণ-বিধিকে ফাঁকি দেওয়াটা নীতিগত ভাবে ঠিক কি না, সে প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে।’’
—ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy