Advertisement
১১ মে ২০২৪

দিদির ইচ্ছেয় ভোটের আগে ২১ হেলিপ্যাড

মালদহ, বালুরঘাট, দুর্গাপুর, শান্তিনিকেতন, গঙ্গাসাগর, হলদিয়া। বছর দেড়েক আগে কলকাতা থেকে একে একে এই ছয় রুটে ঘটা করে হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্যে পর্যটক ও বিনিয়োগ টানার কথাই বলা হয়েছিল তখন। যদিও মন্ত্রী-সান্ত্রী বাদ দিয়ে তাতে সাধারণ যাত্রী শেষ কবে মিলেছে, মনে করতে পারছেন না সরকারি কর্তারাই। তা সত্ত্বেও এ বার রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ২১টি স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খরচ ধরা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। প্রশাসন সূত্রের খবর, হেলিপ্যাড বানাবে পূর্ত দফতর। টাকা জোগাবে পরিবহণ দফতর। দিন তিনেক আগে চুঁচুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে ওই দুই দফতরের অফিসারদের ডেকে তিন মাসের মধ্যে হেলিপ্যাড তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য ও সোমনাথ চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

মালদহ, বালুরঘাট, দুর্গাপুর, শান্তিনিকেতন, গঙ্গাসাগর, হলদিয়া।

বছর দেড়েক আগে কলকাতা থেকে একে একে এই ছয় রুটে ঘটা করে হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্যে পর্যটক ও বিনিয়োগ টানার কথাই বলা হয়েছিল তখন। যদিও মন্ত্রী-সান্ত্রী বাদ দিয়ে তাতে সাধারণ যাত্রী শেষ কবে মিলেছে, মনে করতে পারছেন না সরকারি কর্তারাই। তা সত্ত্বেও এ বার রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ২১টি স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খরচ ধরা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।

প্রশাসন সূত্রের খবর, হেলিপ্যাড বানাবে পূর্ত দফতর। টাকা জোগাবে পরিবহণ দফতর। দিন তিনেক আগে চুঁচুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে ওই দুই দফতরের অফিসারদের ডেকে তিন মাসের মধ্যে হেলিপ্যাড তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

কোন কোন এলাকায় হবে নতুন হেলিপ্যাড?

কয়েকটি নমুনা তুলে যাক— উত্তরবঙ্গের বীরপাড়া, বালুরঘাট, দক্ষিণবঙ্গের চুঁচুড়া, কুলতলি, আরামবাগ অথবা হাওড়ার ডুমুরজলা!

সম্প্রতি বালুরঘাটে নতুন বিমানবন্দর গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নতুন অন্ডাল বা কোচবিহার বিমানবন্দর লাভজনক ভাবে চলছে কি না, তার জন্য অপেক্ষা না করেই রাজ্য কেন নিজের খরচায় বালুরঘাটে বিমানবন্দর তৈরি করতে নামল, সেই প্রশ্ন আগেই উঠেছে। ঘটনা হল, একই ভাবে প্রশ্ন উঠেছে ২১টি নতুন হেলিপ্যাডের স্থান নির্বাচন নিয়েও। কারণ, এই এলাকাগুলির মধ্যে কার্যত কোনওটিই পর্যটন-মানচিত্রে নেই। সেগুলি অন্য শিল্পেরও ঠিকানা নয়। এবং রাজ্যের শিল্পের যা হাঁড়ির হাল, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই এলাকাগুলিতে শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনাও দেখছেন না কেউ। নবান্নের এক কর্তাই বলছেন, ‘‘আরামবাগ বা বীরপাড়ার মতো এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্প হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। ওই সব গঞ্জ-শহরগুলিতে না আছে উপযুক্ত সড়ক পরিষেবা, না আছে স্থানীয় মানুষের চাহিদা অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল।’’

তা হলে স্বাভাবিক জনজীবনের ন্যূনতম পরিকাঠামোই যেখানে নেই, সেখানে হেলিপ্যাড তৈরি হচ্ছে কেন?

সরকারের যুক্তি, পর্যটনে গতি আনতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যেই তৈরি হচ্ছে ২১টি স্থায়ী হেলিপ্যাড। বিরোধীদের কিন্তু অভিযোগ, বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর প্রচারের কথা মাথায় রেখেই হেলিপ্যাডগুলি তৈরি হচ্ছে। এমনকী প্রশাসনের একাংশও মানছে, নতুন হেলিপ্যাড তৈরির সঙ্গে পর্যটন কিংবা পরিকাঠামো উন্নয়নের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই অফিসারদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী ইদানীং বেশ কিছু ক্ষেত্রে সড়কপথ এড়িয়েই চলছেন। দু’দিন আগে চুঁচুড়ায় গিয়েছিলেন জলপথে। এমনকী, কলকাতার আশপাশের জেলায় যেতে হলেও হেলিকপ্টারই পছন্দ মুখ্যমন্ত্রীর। এই মাসেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামে তিনি গিয়েছিলেন আকাশপথে।

এ দিকে, হিসেবমতো পরবর্তী বিধানসভা ভোটের আর এক বছরও বাকি নেই। ভোট এগিয়ে আসতে পারে বলেও জল্পনা শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা খোলাখুলিই বললেন, ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লেই হেলিকপ্টার আরও বেশি করে ব্যবহার হবে মুখ্যমন্ত্রীর ভোটের প্রচারে। মূলত সে দিকে তাকিয়েই পূর্ত দফতরকে দ্রুত হেলিপ্যাড তৈরি করতে বলা হয়েছে।

গোটা বিষয়টি নিয়ে শাসক দলকে বিঁধেছেন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘এত হেলিপ্যাড আর কোনও কাজে লাগুক বা না লাগুক, ভোটের প্রচারের সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার ওঠা-নামা করতে কাজে লাগবে। ভিআইপি-দের যাতায়াতের প্রয়োজনে অস্থায়ী হেলিপ্যাড যে কোনও জায়গায় করা যায়। কিন্তু পাকাপাকি কেন?’’ বস্তুত, এই যুক্তিতেই বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করতে চাইছে নবান্নের অন্য একটি সূত্র। তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়োজনে অস্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি করে নেওয়াই যায়। কিন্তু রাজ্যের লক্ষ্য পরিবহণের স্থায়ী পরিকাঠামো তৈরি করা।

কিন্তু ঘটনা হল, কাগজে-কলমে ‘হেলিকপ্টার পরিষেবা যে কেউ পেতে পারেন’ বলা হলেও বাস্তবে তা মুখ্যমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্তাদেরই বাহন হয়ে রয়েছে। যে কারণে, মূলত মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই হেলিকপ্টারের ভাড়া বাবদ প্রতি ৪০ ঘণ্টায় ৫০ লক্ষ টাকা গুনছে পরিবহণ দফতর। এই পরিষেবা থেকে কখনও লাভের মুখ দেখেনি তারা। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘গত চার বছরে অনেক প্রচার এবং শিল্প সম্মেলন হলেও রাজ্যে নতুন করে কোনও বড় বিনিয়োগ আসেনি। দেশের পর্যটন মানচিত্রেও পশ্চিমবঙ্গের নাম উজ্জ্বল হয়নি। তাই পর্যটক বা বিনিয়োগকারী — হেলিকপ্টার চড়ার জন্য কার্যত কাউকেই পাওয়া যায়নি।’’ তা হলে হেলিকপ্টার পোষা কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের অন্দরেই।

নবান্নের সূত্র জানাচ্ছে, বছরখানেক ধরেই স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি নিয়ে প্রশাসনের নানা মহলে আলোচনা চলছিল। কিন্তু কোথায় কোথায় তা তৈরি হবে, চূড়ান্ত করতে পারেননি পূর্ত, পরিবহণ ও স্বরাষ্ট্র দফতরের আধিকারিকেরা। শেষে ভোট এগিয়ে আসার জল্পনা শুরু হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর অফিস নড়েচড়ে বসে। তাদেরই পরামর্শে এ বছরের জানুয়ারি মাসে একটি ‘স্ক্রিনিং কমিটি’ তৈরি করে পরিবহণ দফতর। পূর্ত দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে মাথায় রেখে ওই কমিটির সদস্য করা হয় ফ্লাইং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বেঙ্গল এরোট্রোপলিস প্রোজেক্ট লিমিটেড ও পরিবহণ দফতরের প্রতিনিধিদের।

তবে কোন কোন শহরে হেলিপ্যাড তৈরি হবে, তা চিহ্নিত করে দিয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ মহলই। সেই তালিকাই স্ক্রিনিং কমিটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রকল্পের উপযুক্ত স্থান খুঁজতে বলা হয়েছে। জেলা সদরের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে পুলিশ লাইন বা সার্কিট হাউসকে। কারণ সেখানে সরকারি জমি অঢেল। শুধু হেলিপ্যাড নয়, ভিআইপি-রা যাতে নিরাপদে হেলিকপ্টারে ওঠানামা করতে পারেন, তার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের বিশ্রামঘর-সহ অন্যান্য ব্যবস্থাও তৈরি করতে বলা হয়েছে পূর্ত দফতরকে।

কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘হেলিপ্যাড ‘স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন’ মেনেই তৈরি হয়। কিন্তু তা যদি গ্রামে-গঞ্জে বা প্রত্যন্ত প্রান্তে হয় তা হলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। জনগণের করের টাকায় রাজনীতির চাল খেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মুখে মা-মাটি-মানুষের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে মাটিতেই পা পড়ে না তাঁর। আকাশে চলতে চলতে মানুষ থেকেও ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE